Thursday, December 14, 2006

ঘুম

ঘুমিয়ে যাওয়াটা কখনও কখনও গোল্লাছুট কিংবা ক্রিকেটের মতোই সহজ।
মনে আছে পাড়ার ছয় বছরের মনির একবার ঘুমিয়ে গেলো। ওরা গোটা ছয়েক ডানপিটে গোল্লöাছুট থেকে ক্রিকেটে ফিরছিল মাত্র। স্কুল ফিরতি পথে মাÿ বকাবকিভর্তি স্কুলব্যাগটা লিচু গাছের তলায় দলা করে সাদা স্কুল শার্টে ধুলো-কাদা মেখে ওরা মুরলিধরণের গুগলি পর্্যাকটিস করতো। দুপুরটুকু ঘরের ঘুপচিতে কাটিয়ে বিকালে আবার মুরলিধরণ। সেদিন কোনো হরতাল মরতালের দয়ায় স্কুল খালি করে খুব সকালেই মাঠে হাজিরা দেয় ওরা। এতো সকাল সকাল মাঠের আধভেজা ঘাসে পা পড়লে চড়× পাখির মতো স্বাধীনতা ওদের আশ্চর্য রকম উচ্ছò করে। উত্তেজনার বশেই কিনা কে জানে পল্লবের থ্রো তানভীরদের ছাদে আটকে গেলে ওরা অগত্যা মণিরদের চিলেকোঠায় হাজির হয়ে অন্ধকার হাতড়ে কিছু বড়শি বের করতে সম হয়। বল না থাকলেও বড়শি-মাছ খেলায় হরতালের হক খানিক আদায় হবে ভেবে সকালের নাস্তার নরম নরম মিষ্টি পায়েশ, চালের রুটি ফেলেই ওরা ছয়জন নদীর পাড়ে হাজির হয়ে যায়।

সূয্যি মামা ততণে আঁচড়ে পিঁচড়ে রেন্যুকের বিরাট ঝাউ গাছটার মাথায় উঠে গলাছেলা শকুনগুলোকে বিনে পয়সার তাপ দিচ্ছে। এই যে চিকন জলের যে গড়াই দেখছো, ওটাই ভরা বর্ষায় পুজোর প্রতিমা, পাড়ভাঙা কলাগাছ, কাঁচাবাড়ি, বেগুনতে, আখের শেকড় ইত্যাদি গিলে গিলে এমন হয় যে রেন্যুকের চিলতে বাঁধে শহরের সব জুটিই বিকাল বিকাল চিনাবাদাম চিবুতে চিবুতে জলের আশ্চর্য পাক দেখতে হাজির হয়। পানিতে পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে শুশুক ওঠার কালে ডুবন্ত সূর্যের লাল আলো ওদের রহস্য দেয়। চার বছরের শিশু কন্যারা তখন বাবার আঙুল আরো শক্ত করে আঁকড়ে বাড়ি ফেরার শক্তি পায় যেন।

ভরাপাকের এই গড়াই নদীই শুকনা কালে আলগোছে থিতিয়ে কেমন চিকন হয়। বাঁধের গোড়ায় পুরো বর্ষা জুড়ে স্রোতের আঘাতে আঘাতে যে গর্ত হয় সেখানে শুকনা কালেও কয়েক মানুষ জল ঠান্ডা হয়ে জমে থাকে। বাকি নদী তখন বালির পাহাড়, টমেটো তে হয়ে ওপারের হরিপুরেরও খানিকটা আলতো ঢেকে দেয়। দুপুরে নিয়ম করে বালির সমুদ্দুর থেকে হালকা ভাপ ওঠে। ওই বালু হাতড়ে সাহস করে পশ্চিমে এগিয়ে গেলে কতক হোগলা ঘেরা স্বর্গ বেয়ে শেষে চিনেবাদামের চাষ নজরে আসে। তো বাঁধের কোলে এই নরম ঠান্ডা জলে ছিপ ফেলে কতক এলে, বেলে, ইঁচা খোঁচাখুঁচি করে সূয্যিমামাকে মাঝ আকাশে ঠেলে দেওয়ার প্ল্যান করে মনির-পল্লবেরা। অবশ্য সূয্যিমামা পুরো মাঝ আকাশে চড়ার আগেই বাবার চর-থা¯ড়ের ভয়ে আগাম হরতাল কর্মসূচী গুটিয়ে আনতে ভেজা বড়শিতে সূতা পেঁচিয়ে ফেলে ওরা। বাড়ির পথটুকু পলিথিনের পেটে সদ্য গড়ে ওঠা একুরিয়াম নিয়ে খেলতে খেলতেই শেষ হয়ে যায়। বাড়ির খুব কাছাকাছি আসার পর মনিরের অনুপস্থিতি আন্দাজ হয় পল্লবের। çকিরে, মনির কই?ÿ মনির নেই। ওরা তখনও জানেনা, দুই সপ্তাহের জমানো খুচরো পয়সাগুলো নেভি ব্লু প্যান্টের পকেটে নিয়ে জলের গভীর শীতলে চুপচাপ ঘুমাচ্ছে মনির।

পল্লবদের দলটা মেজাজ খারাপ করে ইতি উতি ঢু মারতে মারতে নদীপাড়ে হাজির হয় আবার। নাহ, কেউ নেই কোথাও। একুরিয়ামের খেলনাগুলি মরে গেছে বলে মনিরের উপর রাগ হয় ওদের। চৌধুরীবাড়ির বাশবাড়িটায় একবার খোঁজ করতে করতে ওরা মোটামুটি একমত হয়- পরদিন মনিরকে কিছুতেই খেলায় নেয়া হবেনা। হঠাৎ শ্বেতীরোগীর মতো চেহারা ভীষণরকম সাদা করে দাঁড়িয়ে পড়ে শরীফ। çওর স্যান্ডেল আমি বাঁধের পাড়ে দেখেছিÿ এরপরের ম্যরাথনে ওরা একযোগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে মিনিট কয়েকের মধ্যেই হাজির হয় নদীপাড়ে। হাঁপাতে হাঁপাতে খেয়াল করে নরম বালিতে পড়ে থাকা মনিরের সবুজ স্পঞ্জ জোড়ার পাশে একটা গুবড়ে পোকা মহা বিরক্ত হয়ে মাটি খুবলে যাচ্ছে অনবরত। আশ্চর্যজনকভাবে গুবড়ে পোকাটা সেদিন নিস্তার পেয়ে যায় ওদের হাত থেকে। ওপাড়ের বালির পাহাড়, নদীপাড় ধরে বহুদুর নতুন আখের খেত, রেন্যুকের শিশুবাগান, চাঁদমাড়ি- সবটা শক্ত চোখে পরখ করে ওরা। এরপর সবুজ স্পঞ্জ জোড়া ভাগাভাগি করে হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে। সারাটা পথ আর কথা হয়না একটাও।

পরদিন বিকেলে প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা পানিতে ভিজে নরম হয়ে ভেসে উঠলে নেভি ব্লু প্যান্টটা প্রথম নজরে আসে পাগলপাড়ার খয়বারের। বিকালের দিকে নদীপাড়ে ছেড়ে দেয়া গরুগুলো কুড়াতে তাকে প্রতিদিনই আসতে হয়। কিন্তু এভাবে নেভি ব্লু প্যান্টপড়া কাউকে নিস্তরঙ্গ জলের উপর এমন নিশ্চিন্তে আগে কখনো ঘুমাতে দেখেনি খয়বার। খবরটা অলিগলি হয়ে কমলাপুরের গভীরে ঢুকতে খানিক সময় নেয়। এর পরপরই হ্যামিলনের বাঁশিঅলা হয়ে রাস্তায় নেমে আসে মনিরের মা। খসে পড়া আচলটায় পথের যাবতীয় খুঁটি নাটি টানতে টানতে নারী কন্ঠের চিকন মাতম নদী তীরের দিকে ছুটতে থাকে। পথের অন্য সব আলগা পথিকও সঙ্গী হয় তার। সন্ধ্যার খানিক আগে বাঁধের পাড়ে যে ভীড় হয় এরকম ভীড় আরেকবার হয়েছিল বেশ আগে। ÿপাড়া মিলে বয়স্কদের কাবাডি খেলার ফাইনাল ছিল সেদিন। পুরস্কারের তরতাজা কালো গরুটা পাশেই বাঁধা ছিল। মাইকে বিটকেলে স্বরে গলা ফাটাচ্ছিল কে এক নবীশ। ফাঁকে ফাঁকে হিন্দী গান। সেসব হুলুস্থুলু অবশ্য আজকে নেই। আজ সবাই এসেছে চুপচাপ, ঘুম দেখতে। শুধু মনিরের মায়ের চুপ করার অবসর হয়না। মনিরের ঘুম যে কেমন গভীর তার চেয়ে ভাল আর কেই বা জানে? ডিস্টার্ব হবেনা জেনেই হয়তো মায়ের মাতম চলতে থাকে উথাল পাথাল। পাড়ের ঘাসগুলো অনেকণ নির্দোষ দলিত মথিত হয় ওর মায়ের গড়াগড়িতে। ঘাসের মায়ায় পড়শিরা অতঃপর মনিরের মাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লে পশ্চিমে লাল পর্দা নামায় সূয্যিমামা। হরিপুরের বেশ দুরের কতক বাড়িঘর আর মসজিদের মিনারে ততক্ষণে সন্ধ্যাবাতি উঁকি দিতে শুরু করেছে। শুধু মায়ের সমস্ত ঘুম ধার করে নিস্তরঙ্গ শীতল জলে ফুলে ফেঁপে বেলে মাছের পরম পড়শি হয়ে তখনও অবিরাম ঘুমিয়ে চলেছে আমাদের ছোট্ট মনির।

No comments: