Thursday, December 14, 2006

Rain in the City of Destinies


আটপৌরে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের এই ঢাকা শহরটার মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ অচেনা নতুন রূপে আত্মপ্রকাশের একটা অদ্ভুত মতা আছে। ব্যপারটা আরেকবার টের পেলাম সেদিন। এটাকে কালচৈত্রী বলা ঠিক হবে কিনা ভাবছি। বৈশাখ এখনও খাতাকলমে আসেনি বলেই চৈত্রকে একটা সুযোগ দিতে ইচ্ছে করছে।

পুরানা পল্টনের পুরনো অফিসের উদ্দেশে যখন রওনা করেছি তখনও সময়টা সন্ধ্যা ছুঁই ছুঁই হয়নি। সত্যি বলতে আমাদের কালচৈত্রী সাহেবের কোন আভাসও তখন আকাশে বাতাসে দেখলামনা। শহরে থাকার একটা কুপ্রভাব পড়েছে আমার উপর অনেক দিন হলো। রাতের নিঝুম টাইপ রাস্তা না হলে আগের মতো আর আকাশ দেখতে দেখতে হাঁটা হয়না। সেদিনও ঠিক বুঝতে পারিনি আকাশের চেহারা কিছু অতিরিক্ত গোমরা ছিল কিনা। বাতাসের গতিও আহামরি কিছু ছিলনা যে জীবন জীবিকার হাজার ব্যস্ততা ছাপিয়ে তা থেকে ঝড় বৃষ্টির কোন আভাস করতে পারি। যে পথ দিয়ে হেঁটে গেলাম ওগুলো তখনও সদ্যবিগত মার্চের নিষ্ঠুর উত্তাপের ঘোরতর সমর্থক- খটখটে হয়ে আছে। বেশ, খটখটে হয়েই থাক। সমস্যার তো কিছু নাই।

তবে চিন্তায় কিছু ঘাটতি ছিল। কারণ সন্ধ্যার কিছু পরে আমরা ÿজন যখন ঈষৎ ঠান্ডা হয়ে আসা মোগলাই ভাগযোগ করে খাচ্ছিলাম, তখন কাছাকাছি ট্রান্সমিটার বিস্ফোরণের শব্দ পেলাম। সেইসাথে অন্ধকারের একাট্টা নাগরিক হয়ে উঠলাম প্রায় সবাই একসাথে। দরজা জানালা সিল করা ঘরের অধিবাসী হলে এই এক সমস্যা। কখন বৃষ্টি শুরু হয়েছে টেরই পাইনি। দিনদুনিয়া সব অন্ধকার হয়ে আসার পর একটু প্রাকৃতিক বাতাসের আশায় যখন জানালা খোলা হলো তখন ফ্রি ফ্রি মনির ভাইয়ের মিনি চিৎকার- আরে বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে তো। ততণে আমরা ভীড় করে জানালার পাশে। বাইরে যেটা হচ্ছে ইংরেজিতে এটাকেই সম্ভবতঃ ক্যাটস এন্ড ডগ্স বলে চালানো হয়। তবে খটখটে ছেড়ে আসা রাস্তায় প্রায় হাঁটুজল মাড়িয়ে যখন মানুষজনকে চলতে দেখলাম তখন মনে হলো মোটেই বিড়াল-কুকুর বৃষ্টি নয়, কম করে হলেও বাঘ-সিংহ হওয়া উচিত।

মরসুমের প্রথম বাঘ-সিংহ বৃষ্টিকে স্পর্শ করতে পারছিনা এটা আমার জন্য সত্যিকারের দুঃস্বপ্ন। আমার প্রচন্ড ইচ্ছা করছিল চুপচুপ ভিজতে। লুঙ্গি একটা জোগাড়ও হলো কিন্তু অচেনা অর্ধচেনার ভীড়ে লুঙ্গি পড়ে চুপচুপ ভেজার কথা বেশ কসরত করেও ঠিক ভেবে উঠতে পারলামনা। অগত্যা পুরাতন অভ্যাস মতো খোলা জানালার পাশে ভীড় করে বসলাম ÿজন। গান বাদ্য হবে। লেট দ্য রেইন কাম থ্রু উইনডোজ। কাপড় জামাকে কিঞ্চিৎ ভিজতে দাও। তাছাড়া বৃষ্টিকে বড্ড অবমাননা করা হবে। সত্যি বলতে কি কবির সুমনের গানটা তখন আমার সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে:
çএসো করো þíান নবধারা জলে বলবে কে আর?
শহুরে বৃষ্টি জল-কাদামাখা নোংরা দেদার
গীতবিতানের শুকনো পাতায় বর্ষার গান
রবীন্দ্রনাথ একলা ভেজেন, আমাকে ভেজান।...ÿ

বৃষ্টিতে ভেজার সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো অশ্রØ লুকাতে বারতি কসরত করতে হয়না। অথচ আমার অশ্রØটা যে তীব্র আনন্দের সেটা আঁতেল সব ফ্রেন্ডদের বোঝানো এক মহা ঝক্কি ঝামেলার ব্যপার। জানালা গলে অতটা বৃষ্টিও আসছেনা যে আমার চোখ ভাসানো নুন-পানিকে মিষ্টি জলে একাকার করে দেবে। ভেতরে কেউ তীব্রভাবে বলছিল- নিঃসঙ্গতা চাই, নিঃসঙ্গতা। এই সৌন্দর্য ভীড় করে দেখার জিনিস নয়। একসময় একাকিই দেখতে চাইতাম। এখন মমতাময়ী একজনের স্পর্শ চাই শুধু। নিকষ অন্ধকারের মধ্যে ঝুম বৃষ্টি পড়বে। মাঝে মাঝে শীতল ঝাপটায় চেহারা ভিজিয়ে দিয়ে যাবে। মাঝে মাঝে ঈষৎ দীর্ঘস্থায়ী বিদ্যুৎ চমকে জগৎ উজ্জ্বল করে দেবে। আমি সে আলোয় মহাসাগরের ঢেউয়ে দুলে ওঠা প্রতিবিম্ব দেখবো। আবার অপোয় থাকবো বিদ্যুৎ ঝলকের, শীতল ঝাপটার, ঢেউয়ের শিয়রে দুলে ওঠা প্রতিবিম্বের। আবার। আবারও।

কল্পনা প্রলম্বিত হওয়ার সুযোগ পেলোনা। আমার আঁতেল বন্ধুজনেরা আধ্যাত্মিক আলোচনায় ÿজে ওঠার অপোয়। এই হিম হিম বর্ষার অপূর্ব সৌন্দর্য বোঝার হৃদয়বৃত্তিই যদি না থাকলো তবে কি হবে এই যুক্তিকর্ষিত আঁতেল মস্তিষ্ক দিয়ে? বেচারাদের জন্য মায়াই হলো। সুরের কিঞ্চিৎ গোলমাল সহ কী যেন একটা গান গেলাম। খুব একটা আফসোস হলোনা অবশ্য। এরপর বিদ্যুৎ বিভাগের কর্তাব্যক্তিদের দয়ায় যখন ইলেকট্রিক ফ্যানটা আবার ঘুরতে শুরু করলো তখন আমার ঘরে ফেরার সময় হয়ে এসেছে প্রায়। সদ্য ফিরে আসা বিজলি বাতির আলোয় অন্যেরা ব্যস্ত হয়ে উঠার এক ফাঁকে দরজা গলিয়ে বেরিয়ে এলাম। চুপিচুপি।

ভাগ্যজোরে মিলে যাওয়া এক রিক্সায় চেপে জলমগ্ন গলিটা পেরিয়ে মেইন রোডে এসে মনে হলো- উঁহু এটা ভিন্ন এক ঢাকা শহর। বৃষ্টি ধরে আসায় বিভিন্ন জায়গায় আটকে থাকা বাসট্রাকগুলো একসাথে রাস্তায় চলার ছাড়পত্র পেয়েছে যেন। যেকÿটা বাস নজরে এলো প্রত্যেকটাতেই ধারণমতার কয়েকগুন বেশি মানুষে ঠাসা। পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে পুরো শহরটাতে কে যেন জলের ঝাপটা দিয়ে গেছে কিছুণ আগে। কাদার দঙ্গল হয়ে উঠেছে যাত্রী উঠানামার জায়গাগুলো। আর মানুষ। বিড়ম্বিত নারী-পুরুষ-শিশু-বৃদ্ধ- কে নেই এই জনতার সমুদ্রে। সবার চোখের ভাষা একটাই। কোনভাবে কাদামাখা শহরটা পেরিয়ে নিজের আস্তানায় সেঁধিয়ে যাওয়া। ওই বিড়ম্বিত জনতার ভীড় হাতড়ে হাতড়ে পারি দেয়ার ফাঁকে হঠাৎ আমার মনে হলো- ইটস ডিফ্রেন্ট সিটি। সিটি অব ডেসটিনিজ। টেনস অব থাউজেন্ডস অব ডেসটিনিজ।

বাকি পথটুকু এলাম মাথায় ধুম করে ঢুকে পড়া সমীকরণটার সত্যতা মাপতে মাপতে। মেইন রোডে এসে আমাকে আগের রিক্সাটা ছাড়তে হয়েছিলো। বাসের জানালা ÿলে ভেতরের যে আটসাঁট ভীড় নজরে এসেছিল তাতে বাসে চড়ার খায়েশ অনেক আগেই মিটে গিয়েছিল। বাকি ছিল রিক্সা। পল্টন মোড় থেকে পানির সাগর লাফিয়ে লাফিয়ে প্রেসকাব পেরিয়ে আসার পরেও কোন ফাঁকা রিক্সা চোখে পড়লোনা। উপরন্তু কপাল জোড়ে যারা রিক্সা জুটিয়ে ফেলেছিলেন তাদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল হালাকু খানের রণোন্মোত্ত বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জয়ী হয়ে মাত্র ফিরছেন। প্রেসকাব সাঁতড়ে হাইকোর্টের হাই ফুটপাতে উঠার পরেও হালাকু খানের সাথে যুদ্ধে জয়ী হওয়ার কোন সম্ভাবনা না দেখে অগত্যা হাঁটা পায়ে পানিপথের যুদ্ধ করতে করতেই বাসামুখী হলাম। সারাপথ একই দৃশ্য দেখতে দেখতে আসা। আমার মতোই অসংখ্য পানিপথের যোদ্ধা, হালাকু জয়ীও অনেক। আর বাসের বিকট ভীড়ে যারা কোনমতে একটা সিট বাগাতে পেরেছিলেন তাদের কাছেতো চাঁদে ভ্রমনের আনন্দও প্রায় পানিভাত।

শেরাটনের সামনে এসে দেখলাম পশ্চিমাকাশে নারিকেল গাছ দেখা যাচ্ছে। খুবই অপরিচিত দৃশ্য। ঘটনা কি? পরে বুঝলাম পশ্চিমাকাশ আড়াল করে রাখা এতদিনের বিরাট গ্রামীনফোনের বিজ্ঞাপন সাইনটার অকাল পতন হয়েছে। একটা গলির মুখ পুরোপুরি বন্ধ। আরো বেশকিছু পানির সাগর মহাসাগর লাফিয়ে ভীড়াক্রান্ত ফুটপাত ধরে যখন হাঁটছি তখন ঘোড়া ডিঙিয়ে ঘাস খেতে আগ্রহী টাইপ এক মোটর সাইকেল আরোহীকে দেখলাম ট্রাফিক জ্যামে আটকে থাকা মেইন রোড ছেড়ে ফুটপাতে উঠে এসেছে। আগে আগে বেরুতে চায়। কিছু বলার সুযোগই পেলামনা। বেচারা হর্নের শক্তিমত্তা পরীা করতে করতে ফুটপাত দিয়ে এগিয়ে গেল। আমি নিশ্চিত বেটাকে আবার ব্যাক করতে হবে। কারণ ফুটপাতের ওই মাথায় যে পানি দেখে এসেছি তাতে মোটর সাইকেল নিয়ে যাওয়া সম্ভব না। ফুটপাতে মোটর সাইকেল তুলে দেয়া কোন বেকুবের জন্য এই প্রথম একটু মায়া হলো।

শাহবাগ মোড়ের কাছাকাছি এসে অতি পরিচিত জায়গায় খুবই অপরিচিত দৃশ্যের ভীড়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম কিছুণ। অসম্ভব ভীড়। কেমন যেন বোকা বনে যাওয়া মানুষগুলি চোখের সামনে মানুষে ঠাসা গাড়ি চলে যাওয়া দেখছে। çতিল ঠাঁই আর নাহিরেÿ অবস্থা। সবার নাকে চোখে ফেলে আসা ডেসটিনির ঘ্রাণ। আমোদ ভ্রমনে বেরোনো ওই যে দম্পতি- নিজের ডেরায় ফিরতে কত রাত হয়ে যাবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠেছে। অস্থির হয়ে উঠেছে কাপড়ের পোটলা বগলে দরিদ্র মহিলা, পানের দাগলাগা পাঞ্জাবি পড়া বৃদ্ধ, নতুন জুতা পানিতে ভিজে যাওয়ার কষ্টচাপা স্কুলবালক, নাটকের আড্ডা থেকে ফিরতি পথে সংস্কৃতিপ্রেমী যুবতী, হাসপাতালে স্বামীকে দেখতে আসা গ্রাম্য মহিলা, সাথে অপুষ্ট শিশুপুত্র, পকেটমার হয়ে যাওয়া সদ্যঢাকামুখী চাকরীপ্রার্থী যুবক, জমজ ছেলেদুটোকে শিশুপার্কে বেড়াতে নিয়ে আসা মধ্যবিত্ত দম্পত্তি, দলবেঁধে ঘুরতে বেরোনো সিটি কলেজের একদল ছাত্র, পরিপাটি সিঁথিকাটা সচিবালয়ের কোন কর্মচারি, ওভারটাইম শেষে ফিরতি পথে টিফিন ক্যরিয়ার হাতে গার্মেন্টসের গুটিকতক কর্মচারি। দৃশ্যত ধনী এক লোককে দেখলাম মোবাইলে সম্ভবতঃ ড্রাইভারকে বেদম গালাগালি করছে- গাড়ি আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন। বেচারা বুঝতে পারছেনা গালাগালিতে আজকের ঝড়াহত ঢাকা শহরের কোন ঊনিশ বিশ করা যাবেনা। একটা শিশুকে শুধু দেখলাম বাবার একটা আঙ্গুল আঁকড়ে ধরে ঝাপসা হয়ে যাওয়া সোডিয়াম বাতিটাকে খুব অবাক হয়ে দেখছে।

ঝড়ের শেষে আকাশ প্রশান্ত। ধরণীতে অদ্ভুত বিপর্যয়। কারণ উদ্ধার করা কঠিন কেন যে তখন আসহাবে কাহাফের ঘুমন্ত বিশ্বাসীদের কথা মনে পড়লো। মনে পড়েছে- হয়তো খুব উষ্ণ অন্তরঙ্গ ডেসটিনি ছিল ওটা, সেজন্য। দিন কয়েক আগে জন ডান পড়েছি সেজন্যেও মনে পড়তে পারে: çআই ওনডার, বাই মাই ট্রথ, হোয়াট দাউ এন্ড আই ডিড, টিল উই লাভ্ড, ওয়ার উই নট উইন্ড টিল দেন..... অর þíরটেড উই ইন সেভেন স্লিপারস ডেন?ÿ বাসায় পৌঁছতে পৌঁছতে খুব পরিস্কার বুঝতে পারছিলাম, আমার মধ্যে একটা অনিবার্য কবিতা জন্ম নিচ্ছে। ভালবাসার মধুর যন্ত্রণায় ছটফট করে করে কিছু মনে হয় হারিয়ে ফেললাম কয়েকদিনে। শেষমেষ বার কয়েকের ছেঁড়া ছেঁড়া প্রচেষ্টায় নাতিদীর্ঘ কবিতাটা দাঁড়িয়ে গেল একরকম; এরকম:

বৃষ্টিধোয়া শহর অনেক দুরের স্মৃতির মতো, অস্পষ্ট;
হামাগুড়ি দিয়ে অস্তিত্বের গভীরে নিঃশ্বাস ফেলে যাওয়া
আধভেজা মেঠো ঘাসের þíিগ্ধতা অতঃপর।
অথবা নতুন বিশেষণে þíান করে ওঠা
হিম হিম মধ্যরাতের সদ্যজাত উপন্যাসের নাট্যরূপ:
çসিটি অব ডেসটিনিজÿ
অনেক বিড়ম্বিত নারীমুখ আর
পিতামহের অভিজ্ঞ খসখসে আঙ্গুল অাঁকড়ে ধরা
আপাতঃ নির্বোধ কিশোরের চোখে-
উর্ধ্বাকাশের গতিময় উজ্জ্বলতায় একক বিমূঢ় হয়ে ওঠা বিস্ময়।
আমরা হেঁটে হেঁটেই চলো সমুদ্রের ঘ্রাণ শুঁকে নিই,
শঙ্খনীল জলে ডুবে খুঁজে নিই ÿমুঠো ঝিনুক।
কেদমাখা শহরে নিত্য নেমে আসুক আকাশের হলুদ বাগান,
শিশুর বিস্ময়ে জেগে থাক রাজপথ।
তবু শুধু পপাতিত্বের মৃত্যুসঙ্গীতবাহী বাহন
কিংবা দমকল দমকল লাল পোষাকের সাঁজোয়া যান নয়ÿ
সকল অপঙ্গু মানুষকেই অকস্মাৎ এই দুঃস্বপ্নময় প্রহরে
অতি পরিচিত শীতল আশ্রয়টি খুঁজে নিতে দাও।

No comments: