ভোর হওয়ার সূত্রটা বছরের এসময়টাতে খানিক বদলে যায়। নিশাচর যানবাহনগুলোর গতি স্লথ করে কিছু মৌসুমী আয়-রোজগারের আশে ভুঁড়িঅলা ট্রাফিকগুলো লালচোখে জেগে থাকে সারারাত। ওই লাল চোখের আশ্রয় প্রশ্রয়ে জেগে থাকা ক্ষণেক লাল, ক্ষণেক সবুজ সিগন্যাল বাতিগুলো ঘেঁষে খুব ভোরের অলস রাস্তায় কমদামি চ¯লে চট চট আওয়াজ তুলে অনেক ফজর-ফেরত পদশব্দের কোরাস হেঁটে গেলে দারুণ শুনশান হয়ে পড়ে আমাদের এই মোড়টা। তখন ঘামে চটচটে ট্রাফিকের মৃদু নাসিকাসঙ্গীত আর কিয়তদূরের বিহারী হোটেলের টেপরেকর্ডারের উর্দু গজল ছাড়া অন্য সব শব্দ প্রত্যুষের বিশ্রামে মগ্ন হয়ে পড়লে আরেকটি মন্থর দিনের প্রস্তুতি নেয় সূয্যিমামা। আমাদের অণুগল্পের শুরু তেমনই এক নাতিশীতোষ্ণ ভোরে।
আমরা যেই ঘরের গল্প বলছি সেখানে মেঘহীন দিনের প্রথম সূর্যফলা প্রবেশ করতে করতে কসাইয়ের চাপাতির ঘর্ষণ, নরম মুরগীর কুক্কুর আর রিকসার টুঙটাঙে একলা লম্বা বাজারের পুরোটাই জেগে ওঠে প্রায়। তাই অবশ্যাম্ভাবীরূপে গল্পের শুরু হয় টেবিল-ল্যাম্পের ঈষদুষ্ণ আলোয়। প্রায় সারারাতজাগা আলস্যের পরে ভোরের ওম ওম বিছানা, খুঁটিনাটি দরকারি কাজের রেসিপি, কয়েক টুকরো প্রতিশ্রØতি- এসব সরিয়ে লাল চোখে একটা কনভারসেশানের মুখোমুখি বসতে হলে তোমার অবশ্যই অদম্য শক্তির দরকার। তেমন শক্তি আর আকর্ষণের অভাব হয়না বলেই ছেলেটা অমন শুনশান ভোরেও তার দূরবতী প্রেয়সির মুখোমুখি বসে পড়ে নির্দ্বিধায়।
কথোপকথনের শুরুটা জানার সুযোগ না থাকলেও আমরা জানতে পারি রক্তকরবীটা লজ্জাবতীর মতো নরম সুন্দর লজ্জা পায়। কোন এক জোছনা রাতে যে কটা ছেঁড়া ছেঁড়া পঙক্তি উড়তে শিখেছিলো সেগুলোর উড়ন্ত সৌরভ তার শিরায় শিরায় বয়ে যাওয়া ধলেশ্বরি-যমুনায় আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুনবিক্ষুব্ধ লাভার তীব্র স্রোতে থরথর ভূমিকম্পে কাঁপে রক্তকরবী। আমরা অনেক দূরে বসে সে অগ্ন্যুৎপাতের ফলাফল দেখি। ধলেশ্বরীর উষ্ণ বাস্প নরম মুখের কানায় কানায় জমে উজ্জ্বল জলপদ্ম হয়ে ওঠে। বুকের গহীন অ্যামাজন থেকে উঠে আসা শুদ্ধতম ভালবাসা মৃদু হাসি হয়ে নরম ঠোঁটে ছড়িয়ে পড়লে ধীরে ধীরে ভীষণ স্পষ্ট হয়ে ওঠে স্পার্টা আর ট্রয়ের অগ্নিদগ্ধ ইতিহাস। কিংবা কৃত্রিম অভিমানে ফুলে ওঠা নাসারন্ধ্র খুব সহজ মমতায় ভিজিয়ে তোলে দূরবর্তী দুটো চোখ। নিরবে বন্টন হয় শত শত সমরখন্দ, বোখারা।
রক্তকরবীর লাল শাড়ির কারুকার্যময় আঁচল কখনো মুখ ঢাকে, কখনো কোমল মমতায় আগলে চলে কোমড় ছাড়িয়ে নামা চুলের জাজিম। যে ক-গোছা চুল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে মুখের উপত্যকায় জড়িয়ে থাকে, সেগুলোর ভাঁজে ভাঁজে জন্ম নেয় পৃথিবীর সুন্দরতম প্রেমের পঙক্তিমালা....। নরম প্রত্যুষের সেই দ্বিপাক্ষিক কথোপকথনের বিশদ বিবরণ কানে না আসলেও আমরা একটা নরম অভিযোগের খবর পাই শুধু: ç...তুমি একটা অন্ধ, কালো-সাদা কিছুই বোঝনা...।ÿ অভিযোগের কোন পরিস্কার জবাব পাইনা আমরা। তবে ছেলেটা যখন কথোপকথনের বিমুগ্ধ ঘোর ভেঙে পূর্বমুখী দরজায় দাঁড়ায়, উজ্জ্বল সূর্যের আলোয় বাতাস তখন হাসছিল। তরিতরকারির স্লোগান শেষ করে ফেরিঅলা চলে যাওয়ার পর সেই বাতাসে কোত্থেকে যেন ভেসে আসলো শ্রীকান্তের মাদকতাময় গলাটা: çপ্রিয়ার কি রূপ সেই জানে, সেই জানে ওগো যে কখনো ভালবাসে...।ÿ
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment