Thursday, November 27, 2008

জেগে থাকা মানেই অদ্ভুত রক্তমাংসের পঙক্তি

ধুলিসড়ক, রঙমহল আর অন্ধকারের পোড়াগলি হামাগুড়ি দিয়ে পেরিয়ে এসেছো তুমি। উদ্ধত পদ্মের মতো জেগে আছো এই গোলাপী প্রাসাদের জঙলায়। কে তুমি প্রলংয়করী? তোমার রহস্যে কাঁটা হয়ে গেছে কাগজবাহী নৃতাত্ত্বিক মানুষেরা।

নেপোলিয়ন অশ্বক্ষুরের মানচিত্র বাতাসে উড়িয়ে দিয়ে আমরা মাড়িয়ে এসেছি সহস্র রক্তশরীর। শুঁড়িখানার সমস্ত ঘ্রাণ ছিঁড়ে ছিঁড়ে এই উত্তপ্ত উজ্জ্বল বালিয়াড়িতে এখন ঘুমোবো আমরা। শরাবের মুখর জোসনায় এইসব পরিশ্রান্ত শবদেহদের জাগিয়ে দিওনা আবার।

কোত্থেকে তুমি শিখে এসেছো ঠোঁট আর চোখের সমস্ত যাদুবিদ্যা? তোমার বজ্র আর বিজলীতে আরো একবার ঝলসে গেছে লাল সামিয়ানা, ক্ষুধার্ত শবদেহ আর সুগন্ধী পলেস্তারার মিছিল।

খসখসে অশ্মত্থের চাদর বেয়ে আমি নেমে আসি কখনও সখনও। অশ্রু আর বেদনা দিয়ে শুকনো খাবার কিনে হারিয়ে যাই আঁধারের কুয়াশায়। এই প্রত্ন-পান্ডুলিপির নির্জন কোটরে লুকিয়ে এবার তোমার ঘ্রাণ আর পুরনো শরাব নিয়ে গেলাম।

Sunday, November 16, 2008

আহ্লাদ ও অন্ধকারের সাজঘর

রঙিন রোদ্রের ভেতর দিয়ে তোমরা প্রত্নগুহার পথে হেঁটে যাও। কোলাহলের শিয়রে দাঁড়িয়ে যে পেয়ালায় ঠোঁট রাখো, সেখানে আসলে হলুদ-সবুজ ঘ্রাণ। শবযাত্রার অনুনাদী বাতাসে নিত্য সকাল হলেও তোমাদের ঘুম ভাঙে অথবা ভাঙেনা। মাটির নিচতলায় কখনো ঘুমিয়ে দেখিনি, সত্যিই তোমরা স্বপ্ন দেখো কি না।

কংক্রিটের মেঘ চুষে আনা তীব্র জারক রসে তাহলে আর কি বা হবে? আমি চাইনা পিকাসোর স্বপ্নে আহ্লাদিত উজ্জ্বল চেহারাগুলি আবার আলোর ভয়ে কেঁপে উঠুক। শুধু পুরনো দেয়ালের চেয়ে খানিকটা সজিব হয়ে ওঠো। শুধু দেবদারুর পাতা খসার শব্দের দিকে তোমার অশ্রুদের একটুখানি ঝুঁকিয়ে দাও।

সুসজ্জিত বধিরদের এক বর্ধিষ্ণু জনপদ দেখে এসেছি আমি। সেখানে কষ্টের আপেল, সেখানে পাথরের পাহাড়, সেখানে ধ্রুপদী স্বপ্নের স্ফটিক নিষিদ্ধ বাতাসে বারবার ফেটে গেছে। কয়েকটি জলঘড়ি আর হলুদ মগজ দিয়ে আমি উপন্যাস এঁকে দিয়েছি। আর আত্মপ্রতিকৃতির কণ্ঠ ছিঁড়ে পেরিয়ে এসেছি শীতল-স্বচ্ছ দেয়াল যেখানে কষ্টের প্রশ্বাস জমে জমে প্রতিনিয়ত ইতিহাস হয়ে উঠছে।

Saturday, November 15, 2008

অবসাদ ও অস্তগামী মানবী অথবা শুধুই আঁধারের জন্য

নীলরঙা পোট্রেট, বাচাল জনপদ আর বধির সময়ের পাশে এখনও কি ভেঙে পড়ে নির্বোধ রাত, পদ্মার তিতকুটে পাড়ের মতো? কেমন আছে নুলিয়াছড়ির ঘুমপাহাড়? অথবা সজনে বন ভাসিয়ে কান্নার দ্বিখন্ডিত প্রস্রবণ এখনও কি জেগে থাকে নির্জন সাপের মতো ভয়ার্ত সচকিত?

এইসব প্রশ্নের প্রসাধন খসে পড়ে তোমার অশ্রুরিক্ত ভূগোল থেকে। তুমি কোন নক্ষত্রের গোলার্ধ ধরে আস্তিন গুটিয়ে হেঁটে যাও জানি না। তবু তোমার প্রশ্বাসের লবণে ধসে যায় প্রশান্ত কুটির।

আমি তো এক প্রলম্বিত স্বপ্নের টুকিটাকি তৈজস কুড়িয়ে জড়ো করেছি বহুদিন। এখন এই লাল পলেস্তারা আর সর্বশান্ত সমতটি গল্পের পাশে অপেক্ষার আসন পেতেছি। মরুভূমির ঢেউ বেয়ে সঙ্গিত অথবা কফিনের বহর আসলে আমিই তার গোপন সঙ্গী হবো।

বিবিধ পানপাত্র-কথামালায় একদিন হাশিশের তীব্র ঘ্রাণ এনেছিলে তুমি। বিভ্রম তৃণভূমির অন্ধকারে এত সহস্র রাত কিভাবে হারিয়ে গেছে, হদিস হয়না। কুয়াশা আর নক্ষত্রের পঙক্তির নিচে এখন শুধু লিখে চলা সেইসব নির্মোহ বাসরের গল্প।

এই পদশব্দ, নিশ্বাস আর বিভ্রান্ত অক্ষরমালা আমি ভেঙে দিতে চাই। আমার ক্রুদ্ধ সটান তর্জনি থেকে নিক্ষিপ্ত শরের মতো গোধুলির লালিমায় ফিরে যাও তুমি। নিজস্ব বিষাদ অন্ধকারে আবার আমি তীব্রভাবে বাঁচতে চাই।

Thursday, November 13, 2008

কবি, কফিন আর নির্মোহ আনন্দের উপাখ্যান

লাল সামিয়ানা মোড়া গোধুলির গলিমুখ থেকে নির্গত তোমার শব্দমালা, প্রশ্বাস আর নীলচে বাতাসের মুখোমুখি আমার বেদনাগুলি মেলে ধরতে চেয়েছিলাম, চিলেকোঠার নিষিদ্ধ কপাটের মতো।

গোলার্ধের সমস্ত ক্যালেন্ডার আর নবজাতকেরা এখন ঘুমুচ্ছে। ঘুমের স্বাদ জিহ্বায় নিয়ে এইতো খুলে বসেছি যাতনার উপাখ্যান। হলুদ অ্যাপ্রনের মতো প্রশস্ত সূর্যালোকে দাঁড়িয়ে ভাবো- ভেজানো এই রং-তুলিকে অপেক্ষায় রেখে কতো আর বধিরের সংলাপ শুনবে।

অথবা তোমার নিজস্ব প্রকোষ্ঠের চৌকাঠ-তেলাপোকা মাড়িয়ে ঘরে ঢোকা অতিথিটি নিছক তস্কর। তেমন জগৎ কোথায় বলো, লুকিয়ে ফেলবে তোমার মেঘ, কুয়াশা আর অশ্রুর নরম গল্পগ্রন্থ।

তারচে' কয়েক পুরুষের কষ্টগুলো গুটিয়ে রেখে বসো এই নির্দোষ তক্তপোষে। এই নাও উষ্ণ পেয়ালাভর্তি দরিদ্র মানুষের পঙক্তি। কিংবা এই তস্কর আলোকযন্ত্রকে উপহাস করে তুমি এবং তোমরা হেঁটে যাও। শ্রেণীবদ্ধ প্রাচুর্যের স্তুপে হারিয়ে যাওয়া নক্ষত্রের অটোগ্রাফ অবজ্ঞা করে বড়ই পাতার ছায়াকে হত্যা করো অবিরাম।

তুমি যেই ঘ্রাণের পোট্রেট এঁকেছো অশ্রুর দেয়ালে দেয়ালে, সেখানে এখনো মিকেল্যাঞ্জেলোর ভেজা তুলি কাঁদছে। কোন দরিদ্র বেদনার খোসা এই উর্বরভূমিতে ছড়াতে নেই।

তোমার কয়েকটা হাসি আর এক টুকরো বিকেল দিয়ে একবার শুধু হদিস করো এইসব হরিৎ ফুলের নিজস্ব স্বদেশ। অথবা নির্বোধ তোতাপাখীর মতো শিখিয়ে দাও শেষকৃত্যের আদিম মন্ত্রাবলী।

Monday, November 3, 2008

আঁধারের সমান চুমুক

পূর্বপুরুষের বাস্তুভিটায় সেদিন জলবিন্দু ছিল না। কিশোরকালে, এলুমিনিয়াম জলাধার হাতে উঁকি দিয়েছিলাম অতীতের ভেতরবাড়িতে। পরিত্যাক্ত কংক্রিট পিলারের পথে পথে গবাদি শিশুদের গুঞ্জন। দেশলাইয়ের ক্রোধে ইতিহাস পুড়ে যাওয়ার আগে এখানেই ছিল গোলাপী রঙমহল।

প্রতিবেশীর শীতল কূপে অস্থির চুমুক দিয়ে ফিরে এসেছি বারবার। জলাধারের ঘ্রাণে বদলে গেছে জীবনের রঙ। অস্তিত্বের পাঁচিলে দাঁড়িয়ে আমি শুধু আমাকেই দেখি। বুঝিনা, কোথায় গেঁথে আছে আমার দীর্ঘশ্বাস।

অন্ধকূপের পাথুরে দেয়ালে চিত্রকল্প এঁকে অতীতের নাভিমূলে নেমে যায় ধাতব জলাধার। পষ্ট শব্দে তার ক্ষয়ে যায় অন্যান্য সঙ্গীতেরা।

কয়েক জোড়া হাত ও অশ্রুর মৈথুন

হাত তুললেই
নেমে আসে গজবের সামিয়ানা
আজকাল

অপ্রাপ্তবয়স্করা
হাসে আবার, মুখ টিপে
আর বন্দুকের গল্পে গল্পে নামিয়ে আনে মৃতদেহ
মুঠোফোনের সঙ্গীতের মতো
আনন্দে

জানতে চাই
চিন্তায় জমছে কি না মুহূর্তের পারদ
নিশানা খূঁজছি, খুঁজছি

মেরুদন্ডের নিচতলায় ক্লেদের পাহাড়
যাতনা বলা যায় তারে
মাদুরের শিরোনামে ত্রিভুজেরা নীল হয় খুব

আসছে
সময়ের সংলাপ
কী করে শিল্প হয় নির্যাতন

ভয়
সব বুঝি শেষ হয় হয়
ভয়
কিছুই যে ফুরোবার নয়

Friday, October 31, 2008

বকুলগন্ধী চঞ্চলতা হারিয়ে যাওয়ার পর

নদী শুষে নাও বনেদি শরাবের মতো। আর নাও রঙিন উপসাগর। আলস্য রঙধনু ছুঁড়ে দাও বিছিয়ে রাখা মেঘ আর বিষন্ন আকাশের মলিনতায়। চোখের তৃষ্ণা দিয়ে তোমার নিজস্ব কারাগার থেকে এই বিষাদময় কোলাহলের দুরত্ব মেপে দেখো-- অনায়াসে খুঁজে পাবে ক্রয়যোগ্য অপমান আর অশ্রুর অনুজ মানচিত্র।

এই সুরযন্ত্রের পাঁজরে কয়েকটি বোবা পান্ডুলিপি সাজিয়ে এখন ঝলসানো চিত্রকলার মতো বধির তুমি। শ্যাওলার অন্ধকারে বরং ঘ্রাণ নিয়ে দেখো-- নিশ্চিত মিলে যাবে দু-মুঠো লালচে বাতাস।

Tuesday, October 28, 2008

মাটির গন্ধ মেখে ঘুমোতে গেলাম

বহুদিন এই পথ আর কাঁদেনি তেমন। খসখসে তালুতে কন্যার অশ্রু মুছে গনগনে সূর্য খুঁজতে পথে নেমেছিল জনপদের এক নির্জন সিংহপুরুষ। এই লালমাটির দোভাষী, প্যামফ্লেট, মুমুর্ষু চিরকুট, সবই হায় বোবা হয়েছিল সেদিন। শিমুলের নির্বোধ ফুল শুকোবার আগেই সিংহলের নরম কাদায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রঙিন সংসার এঁকেছিল সিংহের সে জাতক।

ইতিহাসের নীলাভ পাতায় পাতায় সেসব নিরীহ কঙ্কাল, স্বর্ণমুদ্রা আর ষোড়শী কন্যার নরম চিঠি ডাঁই হয়ে ঘুমিয়ে আছে এখনও।

বিঘত ঘনিষ্ঠ স্বজনদের মিছিল আবারও সার বেঁধেছে সূর্যের খোঁজে। এই প্রশস্ত গণিত আর বেতারের কালে ভাঁজ করা আগ্নেয়াস্ত্রে মুগ্ধ সবাই। মোমের গন্ধ শুকিয়ে গেছে ইকারুসের। আর প্রলম্বিত ডানার তীব্র সঙ্গীতে ঢেউ উঠেছে মহাদেশের নাভিমূলে।

ওরা আসছে।

Sunday, October 26, 2008

লাল মাটি আর শান্তিকামী যোদ্ধার দিনলিপি

মরচে বন্দুক ছিল আমাদেরও, ধুলোজমা তক্তপোষে
মাটি, বৃক্ষ আর পড়শি বদলের কালে
অসহিষ্ণু ঘোড়ার শাবক লাফিয়ে উঠেছিল সেদিন
এই লাল পাহাড় আর নরম পলিমাটির গাঁয়ে
আর অসমাপ্ত ক্যানভাস বিছিয়ে রেখে অশ্মত্থের উঠোনে
আমরা প্রতীক্ষায় ছিলাম উজ্জ্বল সবুজ রঙের

অপেক্ষায় ছিল পঞ্চাশ হাজার পিঁপড়ের জ্বলন্ত সেনাবাহিনী
রাইফেল কাঁধে ইটের শুঁড়িখানা পেরিয়ে গিয়েছিল তারা
নেপোলিয়ন আর ওয়াশিংটনের সন্ত্রস্ত বাহিনীর মতো
ভেষজ পাতার আড়ালে সেদিন মুখর করতালি ঝরেছিল
আফ্রিকার নৃত্য আর উন্মত্ত যুদ্ধবাজনার তালে

ছুটির আইল ধরে কেবলি গ'লে যাচ্ছিল আগুন
সমতট ইতিহাসের সবচে' প্রবল সে দাবানল
জ্বালিয়ে দিয়েছিল ভাড়া করা স্পার্টান নৌবহর
নৌযান পাটাতনে দগ্ধ খড়ি হয়েছিল লবণের ঘ্রাণ,
প্রশান্ত ঘুর্ণি আর প্রবাল দ্বীপের প্রশস্ত দীর্ঘশ্বাস
সমুদ্র-পুরাণের পাতায় পাতায় হতবাক দাঁড়িয়ে গিয়েছিল
উত্তর গোলার্ধের বিবস্ত্র নাবিকেরা

পদ্মার সূর্যাস্তে একদিন যে শান্তির শ্লোগান উঠেছিল
তার প্রতিধ্বনী বেজেছে রাইন আর ভলগায়
দানিয়ুব বাড়িয়েছে সমর্পিত ডানার মাস্তুল
লাল সেনাদের ভিড় থেকে শুধু তোপধ্বনি কেঁদেছিল একবার
লাল ফানুসে ভেসে ভেসে বলে গেছে সফেদ স্বর্গদূত
গ্রীক কিংবা ব্যবিলন, যা পাও দৃষ্টির নাগালে
নির্দ্বিধায় জড়িয়ে নিও বুকের গহিনে
ওরা সব এক অবিমিশ্র পূর্বপুরুষের চিত্রময় উপাখ্যান

পোড়াবালির চিম্বুক

তোমার হাসিতে অন্ধ হয়ে যায় ইতিহাসের মগ্ন পাঠক
পাথুরে সিংহের আড়ালে অভিমান তোমার
গুচ্ছ গুচ্ছ ঝর্ণার মতো ভেঙে গ'লে টুকরো হয়
নীল নদের আখ্যান শরীরে জড়িয়ে পেঁচিয়ে
ইতিহাসের রঙমহল ফুঁড়ে উত্থিত হয় অবাক ভাস্কর্য
তুমি আবার হাসো, হাশিশের মাতাল উত্তাপে
আর ক্ষুব্ধ বিদ্যুতের আগুনে ঝলসে যায় চোখ

হাবশিদের নির্বাক ভিড়ে বহুদিন আমিও থমকে ছিলাম
বোবা পিরামিডের মতো, ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে
লোবানের মেঘ ভেঙে দুর্লঙ্ঘ্য কফিন থেকে
বেরিয়ে এসেছিলে তুমি, মরুর উদ্ধত যাদুকর!
কালো মাংসের নিরেট প্রাকার
দৃষ্টির তীর্যক দাবানলে পুড়িয়ে খাক করে
তুমি হেঁটে গিয়েছিলে নীল জলের হাম্মামে

কোমরের কোটরে লুকানো উন্মাদ খঞ্জরের কসম
বিষাক্ত কর্কট, ক্যাকটাস আর যাদুময় আকাশের নিচে
এখনও যেসব রক্তকাতর যুদ্ধ হবে,
আমি তার উন্মত্ত অপেক্ষায় নির্ঘুম থাকি
কাতারে কাতারে হত্যার খেলা শেষ হ'লে
হয়তো নরম বালিতেই ঘুমিয়ে নেয়া যাবে

Friday, October 24, 2008

পাশাপাশি গন্ধম-আগুন

পোড়া প্রাসাদের অলিন্দে এখনও তোমার অদ্ভুত পায়ের ক্রন্দন
ক্রুদ্ধ ভঙ্গিমায় কাঁপছে কারাগার কিংবা ধোঁয়াচ্ছন্ন নরম দিন
আগুনের মাতাল গন্ধেই বারবার সাঁতার হয় নিরব গল্পের দেশে
গোল হয়ে হয়ে বাদামী অ্যাশট্রে আর দুর্বল সময়ের পাশে
যে একাকি পঙক্তি নিজস্ব অশ্রুর কথা বলে, হেসে হেসে,
সেখানে ছন্দ বাজে বজ্র আর বাতাসের মতো

এখনও তোমার ঘ্রাণ মাতাল ভীষণ, অচেনা, চকিত
গরান কাঠের বুকে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছে তামাটে কৈশোর
একগ্লাস ধোঁয়ার আকাশ অথবা ক’ফোঁটা উষ্ণ গরল
তুমি বিলিয়ে দাও বিকেলের ক্যানভাসে, নিজস্ব ক্ষিপ্রতায়

সাঁঝের বাগানে ঝরছে বিকারগ্রস্থ ফড়িংয়ের গান
বিজলীর মুখর ছায়ায় নেশার শব্দ আঁকছে গুটিকয় আর্তচিৎকার
চোখ আর বুক-পকেটে পোড়া প্রাসাদের আস্বাদ নিয়ে
হঠাৎ ঘুমিয়ে যাই পুরনো গন্ধের বুকে
বিলবোর্ড থেকে আরেকটি প্রকান্ড দিন খসিয়ে নিয়ে
মেলে দিই কষ্টের বারান্দায়, স্মৃতি ঝরে টুপটাপ
পথের ধুলিকন্যারা বাস্তুহারা পথিকের মতো থিকথিকে ঘন হয়ে
একঘেয়ে মমতায় ঘিরে ফেলে স্বপ্ন-স্বদেশ
বয়োজ্যেষ্ঠ বিভ্রম সূর্যালোকে মুগ্ধ মগ্ন হয়ে
গুটি গুটি মেঘের ছায়ায় পথে নামি আমিও আবার

Thursday, October 23, 2008

মৃত্তিকাপুরাণ

লাল চামড়ার ব্যাগে বয়স আর পুরনো শহর নিয়ে
ইটের ছায়াপথে কতদিন বলো হাঁটবে তুমি আর
ইতিহাসের ঝড়ের পরে শান্ত হয়েছে অনেক পুরণো নিঃশ্বাস
তারা আজ অন্ধকারে, মহাকালের পরম স্বজন
পুরানের এক ঝাঁপি ওরা একদিন খুলেছিল এখানেই
এই ফুটপাতের গহীন কষ্ট থেকে এখনও উথলে ওঠে
সেই পুরাণ, অপক্ক বকুল আর সোঁদা কাগজের ঘ্রাণ
সন্ধ্যার এই রেল, বিজলিবাতি, বাতাবিনেবু
ঝাউবাগানে দুলে দুলে হারিয়ে যাওয়া নাটাইছেঁড়া স্বপ্ন
সবই তো বাস্প হয়েছে ফিনাইলের ঘ্রাণের সাথে
তবু, পায়ের আওয়াজ তোমার বাতাসের ডানায় ভেসে
আজো ঠিক থমকে থাকে পুরনো সেই মাঠের শিয়রে

আমিতো দেখি, সবখানে শুধু পুরণো সৌম্য মিছিল
সার বেঁধে দাঁড়িয়েছে আত্মমগ্ন লাশের কাতারে
লোবাণের ঘ্রাণে উড়ে গেছে শৈশব, নিস্তব্ধতার কোলাহল
নির্জীব বিষণ্নতায় ঘরে ফিরছে যে নতমুখী সন্তান
আস্তিনে তার গহীন মাটির ঘ্রাণ, ভেজা, উষ্ণ
তবু ফের সকালের জানালায় পাখিরা আসছে উড়ে
দেখো মা! তোমার সবুজ আঁচলে সকালের রোদ এড়িয়ে
বাতাসের গভীর ঘ্রাণে উঠছে জেগে আশ্চর্য বিপুল জীবন...

নির্জনতার মানচিত্র

কষ্টগুলোকে বিনয়ী কনিষ্ঠের মতো কাছে ডাকো কেবলি
কারিগর আঙ্গুলগুলো রক্তাক্ত হয় তাতে,
রক্তাক্ত হয় তালিকাভুক্ত বিকেল, গন্ডদেশ, নিজস্ব স্বজন
হেমন্তের শহরে শহরে পায়ে হাঁটা বালিয়াড়ি পেরিয়ে যাও তুমি
ঘ্রাণ নাও তীব্রভাবে, নিকোটিন আর দুর্বোধ্য দ্রবণের
হয়তো দৃষ্টি আর কল্পনা একান্তে কাঁদছে এখনও, থেকে থেকে
তুমি আর তোমার শরীর- কথা হয় পরস্পর..
ঠিক আছে আরেকটু হাঁটা যাক...

তুমি ভাবো- আবেগের সোনালী চপ্পলেই অনায়াসে পৌঁছে যাবে
ইতিহাস-দর্শনের ছাইচাপা বিবর্ণ যাদুঘরে
হাত বাড়িয়ে ছুঁতে পারবে মৃত্যুর প্রত্যন্ত ভীষণ দুর্গ প্রাকার
কিন্তু মানচিত্রে মরুদ্যান নেই, নেই ছায়ার শরবত
এখনও প্রয়াত শব্দস্রোত নিত্য ভাঙছে দ্যাখো চেতনার ব্যরিকেড
পাহাড়, নদী আর দুর্বোধ্য দুর্গম গুহাচিত্রে উপচে পড়ছে কাগজের কার্ণিশ
বলি কি, দরপত্র-হ্যান্ডব্যাগ রেখে জিরোতে হবে তোমাকে,
আঁচল আর অলসতা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে পড় এখানেই,
ঘন এই প্রাচীন অশ্মত্থের দাওয়ায়
তারপর যদি গাছের পাতা চুঁইয়ে তীব্র ঘুম নামে, ঘুমিও ভীষণ
গ্রামজ রসদ সব বিলিয়ে দিয়ে বাতাসের মিনারে মিনারে

আমি অপেক্ষায় আছি তোমার বৃষ্টিমাখা তীব্র ঘুমের
স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে তারপর যদি ঘুম ভাঙে কোন লালচে নগরে
তবে অন্তহীন পথ-হাঁটার সুযোগ হবে আরেকবার
মৃত্যুর লাল উত্তাপে গ'লে যাওয়ার আগে
সে মহাযাত্রার আর কোন যাত্রাবিরতি নেই...

অন্ধদিনের হায়ারোগ্লিফিক্স

কখনও প্রজাপতির মতো উচ্ছ্বল সন্ধ্যা নামলে
শহর আর শরাবের তীব্র ঘ্রাণে ঘুম ভাঙে আমাদের
পুরাণের গভীরে খোদিত চোখ, চোয়াল আর অন্ধ বাঁশিঅলা
আমাদের ডেকে নেয় বিভ্রম প্রমত্ত প্রান্তরে
জীবিকার চক্ররথে ভেসে যেতে যেতে
আমরা দেখতে থাকি বেশুমার কংক্রিট
আর সুলভ সত্যায়িত সন্তানের মিছিল

শিরিষের আলোর কান্না ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেলে
উদ্বাস্তু ফেরিঅলা, কিশোরী, সন্ধ্যা-নক্ষত্র
সব ঠিক মেলে ধরে পরাবাস্তব গল্পজগৎ
প্রথম ইতিহাসের বয়স্ক অক্ষর নিয়ে
দিগন্তে ঝুলে থাকে রক্তগন্ধী ব্ল্যাকবোর্ড
চারদিকে তখন কেবল
পূর্বসূরীর মিথুন গল্পে থকথকে বিভ্রান্ত তামাটে অতীত

কখনও আবার যদি নিছক কাঁদতে শেখে
পাঁচশ’ রঙিন আঙুল, ভাস্কর, আর অসীম উষ্ণ বাতাস
তবে এক বিষণ্ন শহরতলী, একমুঠো মানুষ
আর কতক মন্থর মৃত্যুগাঁথা গভীর আচ্ছন্ন করে আমাদের
আর সৃষ্টির সমস্ত কুহক অ্যামাজন সাঁতরে
আমরা সহজেই নিমগ্ন হই এক স্পপ্নভ্রষ্ট নিষিদ্ধ তন্দ্রায়...

একক স্বপ্নের চৌকাঠ

ঘোলাটে কুমারী জল দিনলিপি ভাসিয়ে নিলে
আমরা অপেক্ষায় থাকি অতঃপর
ভূমিকম্প, ভূগোল আর কয়েক গেলাস শুভ্র উষ্ণতার
ঔপনিবেশিক জলযান-হুইসেল ঘুমিয়ে তলিয়ে গেলে
শিরিষের আড়াল থেকে উৎক্ষিপ্ত হবে যে বিষাক্ত শর
তার তীব্র প্রতীক্ষায় থাকে বুকের আদিম কেশর
অপেক্ষায় থাকে
মোহগ্রস্থ সেই প্রত্নতাত্ত্বিক মৃত্যু-তৃষ্ণায়

পৃথিবীর সমস্ত অবরোহী সিঁড়ি চুঁইয়ে
অনন্তকাল নামতে থাকলে আরাধ্য অবয়ব
কিংবা তীব্র কুয়াশা-গর্ভে
দিক ভুলে বসে থাকা আরব্য মিকেল্যাঞ্জেলো
কৃষ্ণ ছায়াসকল, প্রেম, নতজানু পত্র-পত্রাবলী
সকলি খসে পড়ে চক্রাকার লালচে আঁধারে
সকল প্রশস্ত হাত অঝোরে ঝরতে থাকে
বাদামী বৃষ্টির মতো

একে একে লেখা হলে সমস্ত চন্দ্রগ্রহণের গল্প
হাত থেকে খসে পড়ে খড়িমাটি, টি-শার্ট, কনিষ্ঠের হলুদ কামিজ
আর প্রয়াত ইতিহাসের কব্জি কামড়ে তখন
শহরময় ঘ্রাণের জগতে গড়িয়ে যায় গাদা গাদা উচ্ছ্বল সময়
সন্ধ্যা, মিছেমিছি নেমন্তন্ন আর বিষদ-বিষাক্ত শব্দক্ষয়ে
মোহাবিষ্ট হয় কেউ, কেউ হয় তন্দ্রাহত
কেউ ফের বিষণ্ন অতীতভ্রষ্টতায় ডুবতে ডুবতে
বিচ্ছিন্ন তামাটে দ্বীপে একাকি দাঁড়িয়েই থাকে অনন্তকাল
প্রখর বিভ্রমে অযুত গ্রহণ-বলয় মহাকালে মিলিয়ে গেলেও
স্বপ্নের রোদ্দুর তবু ঝরতেই চায় না যেন আর..

রোমন্থন অথবা অশ্রু শুকানোর কোশেশ...

কত-শত চিঠির মতন, ভেজা কদমের সন্ধ্যা
শিয়রের পাশ দিয়ে সমুদ্রে মিশেছে
গুনতে পারি না আর
দিন তো কমছে কেবলই...
দীর্ঘশ্বাস রাখবো কোথায় জানা হলো না আজও
তবু ক্ষুদ্র হাতের মুঠোয় লেখা হয়ে থাকে
সমুদ্র আর আকাশের প্রবীণ আখ্যান

পরিচিত ঘ্রাণের চৌকাঠ ভাঙবো বলে
হেঁটেছি যে জঙলার বিজন রাস্তায়
সেখানেও দেখি ধুম্র ধোঁয়ার ভিড়
লালচে চায়ের দোকান, মরচে আসবাব
আর কী অদ্ভুত!
এখানেও তীর্থযাত্রী কতক
হাশিশের নরম বোতল বাড়িয়ে ধরে বারবার

আমি তো এসেছি দূরের সবুজ থেকে
যেখানে তাল আর সুপুরির ভিড়ে সন্ধ্যাজোনাকি
ভেজা মাটির গভীরে লালনের ঘ্রাণ
আপন অতলে ডুবে সেখানে শুধু উড়তে শেখা...
উড়ে উড়ে কেউ রঙধনু হয়, কেউ হয় শঙ্খচিল
কেউ সূর্যের সাথে সাথে
নরম সন্ধ্যার পেটে হারিয়ে যায় চিরতরে

এসব উপাখ্যানই ঘুরে ফিরে চোখে পড়ে
নির্জিব করে দেয় স্বল্পায়ু চেতন
তৃষ্ণারা জমে জমে পাহাড় হয়
শীতল শরাবের লোভে পুরনো দেরাজ খুলি
মনে মনে বুঝি
এইসব স্মৃতির সাগরে পালিয়ে, লুকিয়ে
সহজ আয়েশে
পার করে দেয়া যায় দু-একটি অতিশয় তুচ্ছ জীবন...

যাহ! স্বপ্ন দ্যাখ গিয়ে...

স্বপ্ন পর্যটনে ঘুরে ফিরে
পেজমার্ক দিয়ে রাখি চোখের পাতায়
কী বলবো বলো-
এই দ্যাখো রোমশ হাত, দস্তানা, বোগদাদী হারুণ-রশিদ, দলিল-দস্তাবেজ
মুঘল শরবতে তকলিফ হলে
শেষে বাতিল হবে মসলিন জড়োয়া হাউজ, ফিনফিনে লেনিন, লিনেন সব
ফস করে মিথ্যে বলতে নেই সলিম
আজকাল তুমি হাঁটলেই পা গরম সকলের
তাতে বিয়োগান্তক স্যাঁক দিলে শীত, শরৎ, বিনোদবাবুর লাঠিয়াল- সবাই আরাম পায়
তারপর বিষ্টিতে চিৎ হয়ে উঠোনে ঝালমুড়ি আড্ডার মতো কত্তো মানুষ
মিনিট-সেকেন্ডেই লাল মঙ্গলে এ্যাসপ্যারাগাস, ক্রিকেট, সাইন্স ফিকশান, ইগলু
আর গাদা গাদা ম্যান্দা মারা পোস্ট-এডিটোরিয়াল
চায়ের নলকূপ স্ট্যান্ডবাই
একজন শুধু রেফারির মতো বেহায়া-
পৃথিবী দিয়ে বেসবল খেলে

অগত্যা পেজমার্ক আর নেপথলিনে জমা কেতাব খোলা
গান্ধীর দেউড়ি আর ট্র্যাঙ্কের খাঁজে নস্যির কৌটা, কোলকাতা রায়োটের ঝাঁঝ
টিভির পর্দায় হেসে-নেচে ফয়দা হয় না
বিরাট গ্যাপ
শেষে মহাত্মার ফোটোগ্রাফে কেবল এক গাদা নকিয়া এন-সিরিজ
বিশ বছরে এসএমএস একটা যদি মেলে
শাহবাগ মোড়ে বিধবা বিবাহ দেবে মুকুল আর তার দলবল
প্রতিশ্রুতি দিয়েছে- কোন হুজ্জত হবে না...

লাল তুলিতে ছবি আঁকাআঁকি

একদা মোহনদাস কিংবা ভাগিরথির একক গর্জনেই
প্রাগৈতিহাসিক দুর্বলেরা রুখে দাঁড়াতো ভীষণ
নরম গল্প সেসব আমরা শুনেছি বহু নিরব নিরন্নের কালে
সামরিক তর্জনিতে এখন রক্তাক্ত এক থালা ক্ষুধা
বিবিধ হাহাকার-অশ্রুর নির্যাস, মৃত্যু, এসাইলাম
ছড়ানো ছিটানো থাকে কালচে লাল ফুটপাতে
কৃষকায় পতঙ্গের মতো পৃথিবীতে গড়িয়ে যায়
যে নিরব নিরন্ন পশুর নড়বড়ে মিছিল, নিশিদিন
তাদের আকাশে নিঃশেষ বিশুষ্ক রাত আর রাত
অহংকারে থাবা হানে নবীন নীল নক্ষত্রের জাতক
ঘর্মাক্ত রাতের ওপারেও কেবলই বিষাক্ত বাতাস
অলস ছিন্ন আস্তিন বেয়ে গড়িয়ে পড়েনা কখনও
দিনের লালচে আগুন, যেখানে হাতড়ে পাবে উষ্ণতা

পলিজ মাতার মতো দীঘল নদীর দেশ, সাদা বালুচর
রূপোলি মাছের রূপকথা, কাজুবাদামের ঝোপ
সব লেখা থাকে যে মলিন পাঠ্যবইয়ের ভাঁজে
অলজ স্টেনগানের মতো কাঁধে নিয়েছি সেসব
কাঁধে নিয়েছি নতুন মুদ্রাকথা আর নতুন কথার ঘ্রাণ
সাবেকী শাসক আর শোষিতের তরতাজা লাশ
আর এই দেখো, জলবাইবাগান হাতড়ে হাতড়ে
আমরা বধ্যভূমি কিংবা সেমিট্রির ফটক খুঁজে ফিরছি

বরফকলে কান্নার ঘ্রাণ

তামাক কিংবা লিচুর ঘ্রাণে বড় হ’তে হ’তে ভয়ঙ্কর কৃষ্ণচূড়ার এক আলো করা সকালে এক হাঁটু ঘাসের জগতে শখের যাদুর কাঠি হারিয়ে ফেলে এক ছোট্ট শ্যামল মেয়ে। তারপর লাল ফড়িং আর এত্তো এত্তো বুনোফুলের ঘ্রাণ ভুলে সে বেলা কেবল যাদুর কাঠির সন্ধান চলে। সকাল গড়িয়ে-হামাগুড়ি দিয়ে-দৌড়ে দুপুর হয়, বিকেল হয়, হেমন্ত-শীত-বসন্ত হয়, তবু যাদুর কাঠির দেখা মেলে না ঠিক। শ্যামল মেয়েটা অগত্যা অল্প-অল্প বড় হ’তে হ’তে একদিন মাতৃভূমি ছেড়ে একাকি বেরিয়ে পড়ে।

অল্প বমি-ভাব নিয়ে মেয়েটা যেদিন ময়লা ট্রেনে চাপে, সেদিন তার হাত কাঁপে, পা কাঁপে। দুর্বল হাতে ব্যাগ টেনে পানের পিক-অলা জানালার পাশে বসলেও অনেক পুরনো শহর আর পরিচিত জনদের চেহারা অশ্রুতে ঝাপসা হয়। তারপর কুলিদের কোরাস দেখে ট্রেনের হুইসেল কেঁদে উঠলে মেয়ের হঠাৎ ভীষণ সব অন্যরকম কথা মনে পড়তে থাকে। সে দেখে তার যাদুর কাঠি টুকরো হয়ে জগৎ জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। সেসব টুকরো কুড়িয়ে গুছিয়ে না নিতে পারলে সুয়োরানী-দুয়োরানীর নরম পুরনো খেলার সুখ সে আর কোনদিন খুঁজে পাবে না। এরকম বিষম চিন্তায় মায়ের নিজের হাতে গুঁজে দেয়া নাড়ু-মুড়কির ঘ্রাণটাও একসময় কেমন ফিকে হয় যেন।

শিক্ষক, বাবা-মা কিংবা শুভ্রকেশী গুরুজনদের চোখ এড়িয়ে যেসব নরম বিকেলে মাঠ, পুকুর পাড়, পাবলিক লাইব্রেরি চত্ত্বর, বিকেল-নদীর পাড় আর ফুচকার দোকানে টিন-এজ বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমানো গেছে, সেসব উন্মাদ তারুণ্যের কালে কিভাবে যেন ফিরে ফিরে আসতো শ্যামল মেয়েটির রঙিন যাদুর কাঠি। সেই টুকরোটি কেবল জমে আছে থলেয়। এসব ভাবনায় সওয়ার হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করলে রাজধানীর উষ্ণ হাওয়ায় গ্রামজ চোখের পানি অগত্যা শুকাতে থাকে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে রঙিন সোডিয়ামের মতো আলোয় জীবনের প্রমত্ত বছর ক’টি উজ্জ্বল সেলুলয়েড হয়ে যায় হঠাৎ।

তখন কেবল স্বপ্ন কুড়িয়ে নেয়ার সময়। রমনা, সোহরাওয়ার্দী, নীলক্ষেতে মোড়া এই কাদামাটি দ্বীপেই কেন যেন স্বপ্নের প্যারাস্যুট ঝরে রাতদিন। এখানে সংস্কৃতির যৌথ ব্যঞ্জনা, বইমেলার ঘ্রাণ, মঞ্চ নাটক, ফার্স্ট ইয়ার, ফটোকপি-লাইব্রেরি, হঠাৎ বিস্ফোরিত শ্লোগান, চারুকলা, শর্ট-ফিল্ম, পেঁয়াজু, আলুর চপ, সস, চা, দেরিদা, ফুকো, সার্ত্র, গার্সিয়া মার্কেজ আর পাবলো নেরুদার শ্রমজীবি কবিতা বুকে নিয়ে নরম ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে থাকার দিনগুলোতে আরেক টুকরো সোনার কাঠির দেখা মিলে যায়। কিন্তু তারপরেই জীবন কেমন যেন চুপসে যেতে থাকে হঠাৎ। জীবিকার জোয়ালের টানে উত্তপ্ত রাজপথ ছেড়ে বরফকলে ঢুকে পড়লে বিশাল আকাশ আর তুমুল বৃষ্টির গল্পগুলো আস্তে আস্তে শুকাতে থাকে যেন। তবু ঝকঝকে সোনার কাঠির খোঁজে একদিন যে ঘর ছেড়েছিল, সেই শ্যামল মেয়ের গোপন বেদনায় বরফকলের অন্ধকারে এক চাপা কান্নার কোরাস উথলে ওঠে আজও, এখনও।

শহরে কতিপয় এটিএম বুথ

রৌদ্রকাষ্ঠ দুর্ভিক্ষের এক রাতে কতিপয় বাউন্ডুলে বন্ধু-বান্ধব বিত্ত-বৈভবের তেলেসমাতি কায়-কায়বার নিয়ে গল্প শুরু করে। বাউন্ডুলেদের কারো পকেটে সামান্য খুচরা পয়সা ঝুমঝুম নড়ে চড়ে তো অন্যেরা আরো ভীষণ রকম হালকা। কেউ হয়তো মা-বাবা-ছোট্ট খুকুকে খুব দূরের ছোট্ট শহরতলিতে ফেলে এসেছে। অগত্যা দুপুরের তাপে ক্ষুধা বেদম রকম চাগান দিলে এরা তপ্ত রোদ্র ভাঙতে ভাঙতে বহুত পুরনো সব কুকুর পাহারা দেয়া তেজস্বী ফুপুর বাড়ি খুঁজে খুঁজে বকুনি ঝকুনি দিয়ে দুই দলা শুকনো ভাত খেয়ে আবার পথে নামে। তো এরকম বাউণ্ডুলেরাই কিন্তু একদিন ঠিকঠিক বিত্ত-বৈভব নিয়ে ভীষণ রকম গল্প বাধিয়ে ফেলে।

গল্পে গল্পে জানা গেলো বিত্ত-বৈভব নাকি ভীষণ ভার্চুয়াল অঙ্ক হচ্ছে দিন দিন। সালমান নামের লোকেরা এক এক মাসে কোন টাকা পয়সা নজরে না দেখলেও বেদম বিলাসে সময় কাটায়। বজলু মিয়ার ড্রাইভিং লাইসেন্স সাইজের ক্রেডিট কার্ড দিয়ে এরা ট্রাম-মাস্ট ট্রামের যাদু দেখায়। অথচ খুচরা পয়সা থাকেনা ওদের আচকানের পকেটে। ওরা এসকেলেটর বয়ে ইলেকট্রনিক্স মার্কেটে যাতায়াত করে, পাম-টপে মোটা অঙ্কের যোগ বিয়োগ করে, নীল আলোয় পিজ্জা-শরমায় সস-মেয়োনেজ ঢালে, বিদেশী সানগ্লাসে রঙিন বিলবোর্ড আর মেঘ মেঘ আকাশ দেখে। ওদের স্পোর্টস কার বর্ষার দিনগুলোয় গরিব পথিকদের বেশ কাদা ছিটিয়ে গেলেও ওরা কিন্তু সেই টাকা-পয়সা ছাড়া ক্রেডিট কার্ডটাই থেকে যায়।

এসব যাদু দেখে দেখে আমাদের সিদ্ধার্থ একদা বাউন্ডুলেদের ভীড় ভেঙে উঠে দাঁড়ায়। তারপর কিভাবে ঠিক জানা যায়না, মাল্টি ন্যাশনাল শীতাতপ ঘরে সিদ্ধার্থের যাতায়াত বাড়তে থাকলে একদিন তার হিপ পকেট থেকে বজলু মিয়ার ড্রাইভিং লাইসেন্স সাইজের ক্রেডিট কার্ড বের হয়। সিদ্ধার্থের ওয়ালেটে তখন খুচরো কয়েনের চেয়ে ভিজিটিং কার্ডের ভিড় দেখে বাউন্ডুলেদের পুরনো জটলাটা অবাক হয় ভারি। এরকম অদ্ভুত অনাচার আর অবাক করা এক রাতে সিদ্ধার্থের মা স্বার্থপরের মতো কেমন অস্থির হয়ে ওঠেন। চিৎকার করে রাতের সৌন্দর্য ফাটিয়ে অ্যাম্বুলেন্স আসে। ট্রলি আর স্যালাইনে জড়িয়ে হাসপাতালে উড়াল দেয়া হয় নিশুথি রাতে। সিদ্ধার্থের সৌজন্যে আমরা খেয়াল করি অনেক হাসপাতালই কেমন মেঘ ছুঁতে চাইছে আজকাল। সিদ্ধার্থ অগত্যা লম্বা প্রেসক্রিপশান হাতে সাত তলা থেকে একরকম উড়ে নামে।

বজলু মিয়ার ড্রাইভিং লাইসেন্স সাইজের ক্রেডিট কার্ড মধ্যবিত্তের ওষুধের দোকানে এসে ম্যান্দা মেরে চুপসে গেলে সিদ্ধার্থের টনক হঠাৎ যেন ভীষণ রকম নড়ে ওঠে। সোডিয়ামে ভিজছে রাস্তাঘাট, ট্যাক্সি-ফ্যাক্সি দেখা যায়না। করুণ অনুনয়ে অগত্যা ভাঙাচোরা এক মিশুক মিললে গহীন রাতে এটিএম বুথের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে সিদ্ধার্থ। ধানমন্ডির মতো নরম নিরব এলাকায় রাত-জাগা এটিএম বুথগুলো থেকে দরকার মতো বেছে নিতে হয় একটি। কিন্তু সিদ্ধার্থ জানেনা সেদিনের মতো শুকিয়ে গ্যাছে তার ক্রেডিট লিমিট। ২৪ ঘন্টার জন্য স্তব্ধ হয়ে গেছে বজলু মিয়ার ড্রাইভিং লাইসেন্স সাইজের তুরুপের তাস। সিদ্ধার্থের অদ্ভুত প্রলম্বিত বেদনাদায়ক অনুপস্থিতিতে অগত্যা সেরাতেই খসে পড়ে তার মায়ের পেসমেকার। আর এককালের ডাকসাইটে বাউন্ডুলে সিদ্ধার্থকে খুঁজে পাওয়া যায় উজ্জ্বল মখমল আলোজ্বলা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিজন এক এটিএম বুথের ঠান্ডা মেঝেতে।

সৈকতের বোন কাস্টমার ম্যানেজার

ভুলভাল বিজ্ঞাপনের যুগে বড় বড় বিলবোর্ড দেখে আমাদের বিবিধ বোধ জাগে। সৈকতের বোনকে দেখেও লম্বা-চুলো বাউলা বন্ধু আমার নানান ঢঙে চিন্তা-ভাবনা শুরু করে। জুতার ফিতা লাগানোর জন্য পেলব মেকাপ কিংবা লাস্যময়ী হাসির জরুরত সন্ধানে ব্যস্ত হই আমরা তখন। জরুরত সন্ধানে কেউ ফোটোগ্রাফি, কেউ স্মার্টনেট, কেউ ফ্রেমিং, কেউ থিমেটিক আইডিয়া, কেউ ড্রেসকোড ইত্যাকার বিবিধ বিষয় আবিষ্কার করে। কেউ নেপথ্য কারিগরের শিল্পচিন্তার মুগ্ধতায় একটানা টেনে চলে অল্পদামী সিগারেট।

বিলবোর্ডে এর মধ্যে রোদ পড়ে, ছায়া পড়ে, বৃষ্টি পড়ে। রাজনৈতিক শ্লোগান, ভুইফোঁড় ব্যান্ডের বাদ্য-বাজনা আর বজ্রপাতের শব্দ প্রতিধ্বণিত হয়। নিয়নের আলোয় মধ্যরাতে হয়তো পরাবাস্তব স্ক্রিন হয়ে ওঠে বিলবোর্ড। তখন কেউ জরুরি প্রশান্তিতে পেচ্ছাব করে, নিষিদ্ধ নর-নারী হাঁটে, টাকা নিয়ে চোটপাট গালাগালির আওয়াজ বাজে, তবু জুতার ফিতা হাতে সৈকতের বোনের হাসি ঠিক বাসি হয়না।

যদিও লম্বাচুলো তারাশঙ্করের কথার গুরুত্ব দেয়ার ব্যপারে আমাদের সর্বসম্মত নেতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়ে আছে, তবু এসব বিজ্ঞাপন, মেকাপ আর তাবৎ দার্শনিক ব্যখ্যা ও আড্ডার ফোকর গলে ভিন্ন এক গল্পের জন্মশব্দ শুনতে পাওয়া গেলো একদিন। সে গল্পে সৈকতের বোনের মেকাপ থাকে না। ভীষণ রূক্ষ খটখটে রোদ্রে স্বপ্নভ্রষ্ঠ মেয়ের পাশাপাশি এক টিফিন ক্যারিয়ার হাঁটে হয়তো, ঝাঁকুনিতে হলুদ ডাল গড়ায় অগত্যা। সেসব রৌদ্রকাষ্ঠ দিনে সৈকতের জন্ম পর্যন্ত হয়নি। চাষাভূষা বাবা একদিন মারা গেলে সৈকতের বোন হিসেব করে দুইবেলা আকাশ দেখতে শুরু করে। ক্ষুধা কিংবা গর্ভমতী মায়ের হা-হুতাসনের চাপেই কি না কে জানে- একদিন এনজিওর মতো ভাল ভাল বিল্ডিংগুলোতে যাওয়ার সাহস হয় সৈকতের বোনের।

পরে ব্রোথেলের মতো লম্বা এনজিও-সুরঙ্গের অন্ধকারে পা গলায় সৈকতের বোন। তখন পুরনো এক স্বপ্নচোরা মেয়ের মেকাপ বাড়তে থাকে বৈকি। বাড়তে থাকে কর্কট ব্যস্ততা, শপিং, জৌলুসের মতো শহুরে কেসসা। সৈকতের জন্ম হয় নরম বিছানায়। ইংলিশ ফোনেটিক্স আর জামদানি শাড়িতে কুঁচি দিতে শেখে সৈকতের বোন। হামাগুড়ি দিতে দিতে স্কুলবয়সী হয়ে ওঠে সৈকত। তারপর একদিন ডাইসেলের ভারি সুন্দর ব্যাগ কাঁধে স্কুলে যাবে বলে জুতা হাতে বোনের দিকে হাঁটতে শুরু করে সৈকত। ততদিনে পুরুষালি পারফিউম আর ডিওডরেন্টে ডুবে ডুবে, শিডিউল ভাঙা কোন এক জোসনায় ভীষণ সুন্দর বিলবোর্ড হয়ে গেছে সৈকতের বোন। সৈকতের বোন এখন কাস্টমার ম্যানেজার।

নিত্যগেইম

ব্রাত্যজনেরা ঝরঝর হেঁটে যায়
পকেট আর পুণ্য ফুরালে
মুহূর্ত কয়েক শীতল বাতাস মেখে
ছুটি পাওয়া প্যারাসুটের মতো
বহুতল ভবন থেকে উড়তে শেখে অতঃপর...

তারপর এক নিরন্ধ্র সময়ে
মেগাসিটিগুলোতে ভীষণ এক খবর হয়
সবজান্তা উজ্জ্বল আলোয়
ঘিরে ফেলে নধর শরীর
বেয়োনেটের মতো উদ্ধত সন্ধ্যা নামে
আর ফিনাইল প্রাসাদের
অটোপসি উৎসব ফুরালে
এক পুরণো বাক্যের চাদরে মুড়ে
ওরা থরথর নেমে যায়
সোঁদা মাটির কুহক গহিনে...

ঘর ছাড়ার মরশুম

কুড়ি বছর পার হতে হতে অন্তরার মতো নম্রচোখ মেয়েদের মায়াবি এক মা-বাবা আর ছোট্ট পুতুলিকে ঘিরে অনেক স্মৃতি জমে যায়। স্কুল-কলেজ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের আঙিনা অন্তরাকে ভীষণ এক ক্রাউডেড হৈ-চৈ মানুষের মধ্যে ফেলে দেয়। বিকেলের আধো-অন্ধকারে অন্তরা মাঝে মাঝে ভীষণ এই ভীড়ের দঙ্গলে মাথা উঁচু করে দাঁড়ালে কল্পচোখ তাকে এক নম্র পুরাতন দৃশ্য দেখায়। সেখানে ভীষণ মায়াবি এক মা-বাবা আর আদরের ছোট্ট বোন অথবা ভাই। আধো-অন্ধকারে নিচু হয়ে সহজেই চোখ মোছে অন্তরা।

অন্তরার চোখ মোছার গল্প অতঃপর বাড়তে থাকে। অল্প গা-গরম, পা মচকে ফেলা কিংবা হাতে গরম পানি ছলকে পড়ার মৃদু খবরগুলো অনিচ্ছায় বাবা-মায়ের কানস্থ হলে মিছে বকুনি আর বিপুল উৎকন্ঠার দুজোড়া চোখের কল্পনায় অন্তরার চোখ মোছাটা একরকম নিত্যনৈমিত্তিক হয়। ছোট বোনটাও ভীষণ বেকুব হয়ে অন্তরার বাড়ি ফেরার সংবাদে মিছেমিছি ছোট্ট ঘরটা সাজাতে থাকে। টেবিলে প্রিয় ফুলদানি, আয়নাটা ঝকঝকে হওয়া চায় আর সিডি প্লেয়ারের পাশে পছন্দের লোপামুদ্রা কিংবা রবীন্দ্র সঙ্গীত। এসব দেখে দেখে অন্তরা যমুনা হয়েছে প্রায়ই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্দেশে ঘর ছাড়ার দিন অন্তরা বোঝেনা ঠিক, কিন্তু গোপনে অগোচরে বড় এক সত্যের রিহার্সেল হয়ে যায়। ক্যাম্পাসের নিয়ন রঙিন সময় জীবনের অনেকগুলো পাতাকে রঙে মাখামাখি করে খুব দ্রুত উড়িয়ে নিলে একদিন হঠাৎই ঘর ছাড়ার মরশুমের মুখোমুখি হয় অন্তরা। দিকবিদিক জুড়ে সুপাত্রের সন্ধান চলে। আর অবাক! ছোট্ট বোনটির আম ভর্তা আর হাজারো খুনসুটির গল্প ভুলে অন্তরাও কিভাবে যেন অচেনা এক পুরুষের জলরঙ পোর্টেট এঁকে চলে মনে মনে।

এরপর হয়তো কোন অঘ্রাণে, হয়তো কোন প্রচন্ড কৃষ্ণচূড়ার দিনে এক অনিবার্য ট্রাজেডির সময়-ক্ষণ নির্ধারণ হয়। সভ্যতার সঞ্জিবন প্রবাহ ঠিক রাখতে প্রকৃতিই যেন অদ্ভুত এই ট্রাজেডির পুণর্জন্ম দিয়ে চলে প্রতিদিন। পরিধান আর বান্ধবদের আনন্দ-গুঞ্জনে অন্তরা অতঃপর একদিন রঙিন হয়। বিপুল কোলাহল, রঙিন বাতি আর ঝাঁঝাল ঘ্রাণে বাতাস মৌ মৌ ভারি হয়। অন্তরার মায়ের আঁচল আর বাবার রুমাল গোপনে গোপনে ভিজতে থাকে দারুণ। অন্তরা কিন্তু কিভাবে কিভাবে দেখে সবই। অতঃপর নিঃসাড় অনুভূতির টিপসই আর খাবারের বিপুল উচ্ছৃষ্টের ঘ্রাণের ভেতর দিয়ে সূর্য অস্ত গেলে বেলিফুলের ঘ্রাণে ভারি এক ঝকঝকে গাড়ির সামনে এলোমেলো দাঁড়ায় কতক আধো-উদভ্রান্ত মানুষ। গাড়ির দরজা গলে অচেনা এক ভুবনে ঢোকার আগে নিঃসাড় মায়ের বুকে শেষবারের মতো ঢলে পড়ে অন্তরা। আর পাথর-মায়ের শাড়ি লবণ-জলে ভাসিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে এক মিথ্যা আশ্বাসই দিয়ে চলে শুধু--“দু-দিন পরেই তো চলে আসছি মা।”

[অদ্ভুত এক বিষাদ আর বেদনা নিয়ে লেখাটি আমার উপর চড়াও হয়েছিল। লিখে তবেই কিছুটা মুক্তি পেলাম। আসলে এই লেখাটি কোন নারীর হতে পারতো। কিন্তু মনে হয় কোন বিষাদময় সত্য তা কখনও হতে দেবে না।]

কফিন

বলেশ্বরির গোরস্থান মাঠে একটা লম্বাটে কফিন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সাতজন। জঙ্গলা টাইপ গোরস্থানটাতে খুব দ্রুত সন্ধা নামছে। পুলিশ অফিসার বিদ্বান কফিনে টর্চ মারলেন। কফিনের এক কোনা থেকে তাজা রক্ত গড়াচ্ছে তখনও। অদ্ভুত একটা দুর্গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। বিশু ডোম নিশ্চিত করেছে এটা কোনভাবেই মানুষের লাশের গন্ধ নয়। পুলিশ অফিসার, গোরস্থান মসজিদের ইমাম, আমরা তিন সাংবাদিক সবাই থ’, বিশু ডোমের একটু কপাল কুচকায়। শুধু নির্বিকার পান চিবোতে দেখা গেলো মসজিদের মুয়াজ্জিন বজলু মুন্সীকে। কফিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললো, ‘আমার কাছে খবরাখবর আছে’। গালের কোনা দিয়ে গলগল করে পানের রস পড়ে গামছা ভিজে গেলেও তাকে বিব্রত দেখালো না। সে চলে গেলো মসজিদের ভেতরে।

খবরাখবর বলতে গোরস্থানের রেজিস্ট্রেশন খাতা। এখানে যেসব কফিন আসে তাদের নাম পরিচয় লেখা থাকে এই খাতায়। কফিনের প্রানীটির পরিচয় খুঁজতে খুঁজতে একনাগারে নিচু গলায় কথা বলে গেলো বজলু মুন্সী। “কোফিন এইখানে রাইখা গ্যাছে সকাল সাতটার দিকে। লোক আসছিল মনে লয় সাতজন। এক লম্বা মোতোন লোক আমারে লাশের নাম-ঠিকানা কইলো। লোকটার শইলে মনে হয় কুষ্ঠু। মুখের চামড়ায় ফ্যাকাশে ধরছে। মাটির দিকে তাকায়া কতা কয়। নাম-ধাম কওনের পর কইলো তাড়াতাড়ি চইলা আইবো...।”

লাশের নাম-ধাম পাওয়া গেছে। অদ্ভুত!! কী ব্যপার বজলু মুন্সী? সিরিয়ালে না লিখে দুই পাতা বাদ দিয়ে লিখেছেন কেন? বজলু মুন্সী ফাঁকা দুই পাতা বারবার উলটায় কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। বিড়বিড় করে ‘আমি তো সিরিয়ালেই লেখিচি...।’ তার কথা কেউ খেয়াল করে না। হুমড়ি দিয়ে নাম-পরিচয় দেখতে থাকে...

নাম: বাদাদা
পিতা: ইনিজা
পেশা: অবসরপ্রাপ্ত শিক, ধুনট কলেজ
ঠিকানা: ৪৩, কুতুবখালি রোড, ধুনট

পুলিশ অফিসারের ওয়াকি-টকি কথা কয়। না স্যার, কুতুবখালি রোডে ৪৩ নম্বর কোন বাড়ি নেই। ৩৭ নম্বরের পরেই নদীর এমব্যাঙ্কমেন্ট। ওখানে ধাম-ধাম করে নদীর ঢেউ আছড়াচ্ছে। আর ধুনটে তো স্যার কোন কলেজই নেই। একটা প্রাইমারি স্কুল আছে শুধু।... পুলিশ অফিসার বিদ্বান হঠাৎ কিছু বুঝতে পারেন না। বোবা সময়ের পর পুলিশের ওয়াকি-টকি আবার সক্রিয় হয়-‘স্যার, এক গাড়ি সোলজার।’ বিশু ডোম মুখে কাপড় বেঁধে হাতে গ্লাভস পড়তে থাকলে পুলিশ ঘুরেন আমাদের দিকে। ‘আপনারা যান ভাই, পরে খবর পাবেন।’ ঘন হয়ে আসা রাতের ভেতর দিয়ে পুলিশের গাড়ির সাইরেন কানে বাজলে হঠাৎই জোরে জোরে শ্বাস নেয়া শুরু করে বিশু ডোম। অদ্ভুত বিকট গন্ধটা আমাদের নাকেও বাড়ি মারে। বালেশ্বরীর গোরস্থান মাঠ ছাড়ার আগে একবার শুধু ঘুরে তাকাই কফিনের দিকে। থই থই ঘন কালচে রক্তে ভেসে যাচ্ছে জনৈক বাদাদার কফিন।

নন্দীগ্রামের গল্প

নন্দীগ্রামের রহস্যময় মাঠে আগুন জ্বলছে আজ। রাতের গুমোট অন্ধকারে আগুন ঘিরে বসা মানুষগুলোকে আদিম গুহাবাসীর মতো ক্ষ্যপাটে দেখায়। বাতাসে আগুনের ফুলকি ওড়া দেখে ছেলে-বুড়ো-নারী। আর দেখে বৃদ্ধ গুরুলি আকবরকে। আগুনের একটু দূরে খানিক উঁচু আসনে নন্দীগ্রামের প্রাচীন এক শিমুল গাছের নিচে সৌম্য ভঙ্গিতে বসে বৃদ্ধ গুরুলি আকবর। তার শান্ত প্রাচীন জ্বলজ্বলে চোখ আর সাদা দাড়িতে গলগলে রহস্য খেলে। আগুনের হলদে-লাল দাবানলের গভীরে তাকিয়ে বৃদ্ধ গুরুলি আকবর গল্প শুরু করেন...

...সেবার আশ্বিনে হঠাৎ খুব একটা ঝড় হয়ে গেলো। মেয়েটার ওড়না যে আমগাছে পাওয়া গিয়েছিল সেই গাছে কোনদিন আর মুকুল ধরেনি। খড়ের চালার নিচে চাপা পড়েছিল সে। আর তার কাপড়-চোপড় ছড়িয়ে ছিল নদীর কূলে এখানে ওখানে। সে বছরই কোত্থেকে কে জানে অদ্ভুত লোকটা এসে উঠলো বাবু অবিনাশের বাড়ি। এত লম্বা কাউকে নন্দীগ্রামের কেউ আর কোনদিন দেখেনি। দিনে শুধু একবারই নদীতে গোসলে যাওয়ার সময় তার চেহারা দেখা যেতো। অদ্ভুত লম্বাটে ভাবলেশহীন চেহারা কিন্তু কী ভীষণ জ্বলজ্বলে চোখ। তার পরিচয় কেউ জানেনা আর কেউ তার সাথে কথাও বলেনি। সে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে কলেরায় মারা গেল বাবু অবিনাশের ছেলেটা। পরের সপ্তাহে মারা গেলেন বাবু অবিনাশ। পরের সপ্তাহে তার স্ত্রী। বাবু অবিনাশের স্ত্রীর দেহ চাটাইয়ে মুড়ে একা একা শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল অদ্ভুত লম্বা লোকটা। আর কোনদিন তাকে দেখেনি কেউ। বাবু অবিনাশের বাড়িতে এরপর বছরখানিক পা পড়েনা কারো...। তারপর একদিন সেটা পাড়ার যুবকদের ক্লাবঘর হয়ে যায়...

বৃদ্ধ গুরুলি আকবরের এরকম সৌম্য গল্পের পর বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। আগুনের ফুলকি ওড়া কমতে থাকে আর ভীষণ রকম স্তব্ধতায় নন্দীগ্রামের ছেলে-বুড়ো-নারী সবাই থমকে থাকে। নাড়ার গাদা পুড়িয়ে আগুনের কুন্ডলি একসময় কান্ত হলে ধীরে ধীরে খালি হয় নন্দীগ্রামের অদ্ভুত মাঠ। আগুন কুন্ডলির ভাপ-ওঠা তাপের পাশে একা বসে থাকেন শুধু বৃদ্ধ গুরুলি আকবর। তার হাতে কাগজের তৈরি ছোট্ট একটা নৌকো। নন্দীগ্রামের ছোট্ট শশি স্কুলের খাতার কাগজ ছিঁড়ে নৌকোটা বানিয়ে দিয়ে গেছে তাকে। দূর আকাশে এক অজানা তারা খসতে দেখে উঠে দাঁড়ান বৃদ্ধ গুরুলি আকবর। লালচে কাল ছাইয়ের আগুনে ছুঁড়ে দেন কাগজের নৌকোটি। মরতে বসা আগুন শেষবারের মতো তীব্র জ্বলে ওঠে শুধু।

পরদিন খুব সকাল সকাল শিশু গাছে ঘেরা নন্দীগ্রামের সবুজ পুকুরটার চারিদিকে ঘন হয়ে ওঠে মানুষের ভীড়। পুকুরের ঠিক মাঝখানে পানির ওপর শান্ত ঘুমিয়ে আছে নন্দীগ্রামের ছোট্ট শশি। ভোরের পুকুরের মতোই গভীর শান্ত নৈঃশব্দের মধ্যে হঠাৎ কারো তীব্র আর্তনাদ বেজে উঠলে আমাদের নন্দীগ্রামের গল্প এবারের মতো এখানেই শেষ হয়।

ছোট্ট এক আগন্তুক

এক রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার বোশেখে হিন্দি চ্যানেলে ভোডাফোনের বিজ্ঞাপন দেখার সৌভাগ্য হয় আমাদের। বিজ্ঞাপনের নাদুস নুদুস কুকুরটা টাই মুখে নিয়ে একদিন শান্তিনগরের খোলা ম্যানহোল থেকে উঠে আসে। তখন তার শরীরে ক্ষুধা। চুপসে গ্যাছে পেট। তবু লাল-সাদা টাই মুখে নিয়ে দৌড়াতে শুরু করে ভোডাফোনের কুকুর।

৬০০ বছরেও ঢাকা শহরে ভোডাফোনের প্রবেশ-ভিসা না হওয়ায় বিভ্রান্তিতে পড়ে কুন্তলার ছোট্ট সাহসী কুকুর। সে অলি-গলি-রাজপথ, দুর্গন্ধ ডাস্টবিন, ভাঙা-চোরা রেলক্রসিং, স্পিডব্রেকার, ক্রাউডেড ওভারব্রিজ ভেঙে দিকবিদিক ছুটতে থাকে। লাল-সাদা টাইয়ের এক ছোট্ট কুন্তলাকে হারিয়ে ফেলেছে সে।

এরপর সপ্তাহ কয়েক বিপুল এই ক্রাউডেড শহরের বিভিন্ন জায়গায় এক হিন্দিভাষী কুকুরকে টাই মুখে দৌড়াতে দেখা যায়। ততোদিনে খাবারের দাম বাড়ে, ফিকে হয় জরুরী বিধির তেজ, তেল-গ্যাসের তীব্র দাম আর বৈশ্বিক উষ্ণতায় জ্বলে-পুড়ে যায় এই ছোট্ট দেশের দরিদ্র হোমোসেপিয়েন্স। জলপাই গন্ধের বিজ্ঞাপন দাঁড়িয়ে গেছে অনেক ততদিনে। ভোডাফোনের হিন্দি কুকুরছানাটি এইসব বিজ্ঞাপন সাইনে অভ্যস্ত হতে হতে দৌড়ে যায় কেবলই।

বোশেখ শেষের আগেই একদিন আবার দুম করে হারিয়ে যায় ভোডাফোনের কুকুরছানাটি। অনেক সন্ধানের পর একটা লাল-সাদা টাই শুধু খুঁজে পাওয়া যায় বঙ্গভবনের প্রধান ফটকে। পাশে কুকুরটির শুকে যাওয়া এক দলা মল।

অস্থির শহরের বিষয়-আশয়

কুহু আর তার বন্ধু ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে। লাল রঙের ব্যাগে খাবার, এন্টি-মসকুইটো ক্রিম আরও বিভিন্ন জিনিস। সবকিছুর নামও জানিনা ছাই। এরপর একুশ শতকের এক অস্থির শহরে কুহু আর তার বন্ধু রাত্রি দেখতে বেরিয়ে পড়ে। অস্থির শহরের বিষয়-আশয় লিস্ট করার জন্য কুহুর কাছে কাগজ আর পেনসিল আছে। কাগজ-পেনসিল হাতে দুই ঘন্টা অস্থির শহরের পথে-ফুটপাতে হাঁটাহাঁটি করে কুহু আর তার বন্ধু। এরপর ক্লান্ত হয়ে ফুটপাতে পা ঝুলিয়ে বসে তারা। আমার সাথে তখনই দেখা। কুহু এখন এন্টি-মসকুইটো ক্রিম মাখবে। চিপস আর জুস খাবে। আমি অগত্যা কুহুর লিস্টটাতে চোখ বুলাই।

ট্রাফিক পুলিশ- ১০ জন
সিগন্যাল পোস্ট -১৫টি (তিনটি নষ্ট)
বিড়ি-সিগারেট অলা (সংখ্যা গোনা হয়নি)
কুকুর (৫/৬ টা)
মাতাল (১ জন)
বেশ্যা (১ জন)
রিক্সাঅলা (গোনা হয়নি। তবে একজন গান গাচ্ছিল এইটা মনে আছে। গানের শিল্পী কোজআপ ওয়ান সালমা)
সিএনজি, ট্যাক্সিক্যাব (গোনা হয়নি)
অ্যাম্বুলেন্স (১টা)
পুলিশের ভ্যান (১টা)
ফুটপাতে ঘুমানো মানুষ (৩৭ জন)

আমার লিস্ট দেখা শেষ হয়না। কুহু আর তার বন্ধুর বিজ্ঞাপন বিরতি শেষ হলে ওরা আবার লাল ব্যাগ কাঁধে এক গলিপথে অদৃশ্য হয়। এরপর অনেকগুলি দিন গেলেও আগ্রহ যায় না ঠিক। একদিন জমে থাকা আগ্রহ নিয়ে কুহুর মুখোমুখি দাঁড়ালেও লিস্টের বিশদ কোন হদিস দিতে পারে না কুহু। শুধু জানা যায় ওই রাতে রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে টোস্ট বিস্কিট হাতে প্রয়াত এক রাজনীতিককে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল কুহু আর তার বন্ধু। আর ওই টোস্ট বিস্কিটের দিকে গড়িয়ে গড়িয়ে আসছিল আরও কতক প্রয়াত রাজনীতিক। কিন্তু একজন ছাড়া বাকিদের নাম মনে না আসায় তখন ওই চরিত্রদের নাম লিস্ট করা হয়নি।

তবে টোস্ট বিস্কিট আর প্রয়াত রাজনীতিক ছাপিয়ে একসময় শুধু অন্য কথা মনে পড়তে থাকে। রাত দেখতে বেরিয়ে কুহু আর তার বন্ধু অনেক কিছুই দেখেছে। শুধু রাতটাই দেখা হয়না তাদের।

বোশেখ দেখবো ব’লে...

ঝকঝকে কার্ণিশে বসে খড়িমাটি, পাকা উঠোন, উঁইয়ের ঢিবি, লাল ফড়িং আর খসখসে আম গাছটার কথা ভাবছিল রোদ্র। পেটে ক্ষুধা আর রাজ্যের সব চিন্তাভাবনা মিলিয়ে রোদ্রের মাথা গরম হয়। মনে মনে সে সবুজ কাঁচের বোতল সারি করে। লাথি দিয়ে যখন বোতল ভাঙবে তখন হঠাৎই হালকা দমকা বাতাস... আর বাতাসে কিছু ধুলোবালি, সুড়কি আর একটা হলুদ বয়স্ক আমপাতা এসে পড়ে রোদ্রর সামনে। রোদ্র একটু থমকায়, হাসে। বোশেখের গন্ধ বুঝি!!

এর পরই পুরনো ক’লাইন কবিতা, হাবিজাবি কি কি গান আর হলুদ রঙের পানজাবিটা ঘোরাঘুরি শুরু করে চোখের সামনে। শ্যাল আই কম্পেয়ার দি টু আ সামার্স ডে...। একটা রঙচটা গানের দুলদুল কোরাস, ঘন দুধের মত মিউজিকের পরপরই বেদম আওয়াজ। লে বাবা! সপ্তাহ দুয়েকের অনেক আয়োজন, লাল-পেড়ে শাড়ি, বেলি ফুলের মালা, মাইক্রোফোন, বাদাম-ভাজা, আইসক্রিম, পান্তা-ইলিশ, একতারা-- সব কিছু দুম করে ভেস্তে গেলো।

রোদ্র অতঃপর ঘর ছেড়ে ঘন দুঃসময়ের মধ্যে বেরিয়ে পড়ে। সূর্যতাপের মধ্যে বিচিত্র গন্ধ। বাতাস ভারি অদ্ভুত রকম রঙিন। কোন আমপাতার উল্টা দিকে মাকড়সার জালের মত গুটি মেরে আছে কেউ--শুয়োপোকা। আর এই যে শহর এখানকার সব ধুলো আসে ইতিহাস থেকে। দক্ষিণ থেকে। প্রত্নপ্রাসাদের ছাদ আর ঘুলঘুলি থেকে। রোদ্র আমপাতা, মেহগনিপাতা, দেবদারুপাতায় মানচিত্র আঁকা প্রত্নপ্রাসাদের ধুলো দেখে আর বিচিত্র কিছু প্রাণীদের মিছিল ঠেলতে থাকে। এই প্রাণীদের ক্রোধ, লোভ, ক্ষুধা, লালসা, সবুজ রঙের মানিব্যাগ, পেতলের আঙটি, বিবিধ ডিজাইনের স্যান্ডেল, ঠান্ডা লাচ্ছির লোভ, গরমের অনুভূতি--ইত্যাকার অনেক কিছুই আছে বলে জানা যায়।

ঘ্রাণেই বোশেখ, রঙেই নাকি বোশেখ। তো রঙ দিয়ে গোসলের পর ভীষণ ভিন্নরকম এক ভাবনায় পেয়ে বসে রোদ্রকে। সে কোন মৃত্যুগামী আত্মার উরুর পাশে দাঁড়িয়ে এই রং-গন্ধ দেখবে। এরপর হঠাৎই থ্যালাসেমিয়া, রক্ত-ক্যান্সার কিংবা মৃত্যুখাদের কিনারে দাঁড়ানো হৃদরোগীদের খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে রোদ্র। সে পিজি দেখে, বারডেম দেখে, আবার পিজি দেখে। তারপর ফিনাইল মাখা ওষুধের এক গাদা দোকান হাতড়ে হাতড়ে এক ত্রস্তপদ ক্রেতার অস্থির পদশব্দ গুনতে গুনতে যেন মহাকালের দিকে হাঁটতে শুরু করে।

বোশেখের রঙ আর ঘ্রাণ তাকে দেখতেই হবে।

বর্ণমালার গল্প

বোবা মানুষের মতো অযুত বছর ধরে
তীরন্দাজ আর বন্দুকের নিষিদ্ধ উত্তাপে
সোমেশ্বরীর শীতল জল ঢেলে ঢেলে
আমরা যে লাল-নীল অক্ষর পেয়েছিলাম
সাদা-কালো রঙ্গমঞ্চের বয়েসী কাতিবেরা
তারই নাম রেখেছিলেন বর্ণমালা
তখন থেকেই শব্দ-বর্ণের বুদবুদ
বাতাসে বাতাসে, গাছের নবীনতম শাখায়
আর এক অপরিসীম বিক্ষিপ্ত ভূখন্ডের কর্ণকূহরে
জীবনের বীজ ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিলো...

অক্ষরে-শব্দে গাঁথা হলো
অজস্র কবিতার মতো বিস্তীর্ণ স্বপ্নরাশি
গল্পের বাদামী ট্রেন ঝিক-ঝিক শব্দ তুলে
তিতাস নদীর কূল ঘেঁষে, পদ্মার ডুবোচর ছুঁয়ে
হাজার হাজার স্বাধীন লাল পদ্মের আলোয়
ইছামতি গ্রামের শিয়র দিয়ে এখনো চলেছে অবিরাম
আর লালনের মেঠো সুর চিলের ডানায় চড়ে
অনায়াস শুদ্ধতায় ছুঁয়ে আসে শঙ্খচূড় পাহাড়
পৃথিবীর উদ্ধত মাস্তুল অনেক
সে শঙ্খচূড়ের নীলাভ আলোয় খুঁজে নেয় পথ...

ভাটির এক ছেঁড়া ব-দ্বীপে যে ক'জন সাহসী নবীশ
জাহাজ ভাসাবে বলে সাগরে নামে
তারা পথ খোঁজে নক্ষত্রে, আকাশে
যে তারার আলোয় খুঁজে পায় সবুজ গন্তব্যের ঘ্রাণ
পাল উজার করে মৌসুমী হাওয়ার গান
সেসব নক্ষত্রের গায়ে রক্তের উষ্ণ স্বাদ
বায়ান্নর কোন এক বিষণ্ন সন্ধ্যায়
ফেব্রুয়ারির রাজপথ থেকে বাষ্পীভূত হয়ে
মহাকাশের অসীম ধাঁধাঁয় মিশে যায় ওরা...

ক'জন বিভ্রান্ত মানুষ

হয়তো কোন দুপুর আলোয়, ছুটিময় শুষ্ক দিনে
তুমুল শিশিরের মতো স্বপ্ন ঝরে কেবলই
ক'খানা পুরনো মুখ, রঙচটা, অভিমানী
কফির ঝাঁঝাঁলো গন্ধে গোল হয়ে বসে
আর স্বপ্নের অজস্র পাতা অনায়াসে উড়ালপঙ্খী হয়
নিবিড় ঘন মিশে যায় কল্পলোকের গোপন সরোবরে

কেউ তবু মেঘের ফাটল থেকে শুধু হাত নেড়ে যায়
চকিতে লাল আলো খসে পড়ে বয়েসী চোখের কোনে
আলো পড়ে খয়েরি চশমা আর জীবনানন্দের ধুসর পাতায়
যেখানে কেবলই বিষণ্ন মাঠ, ভাঁটফুল আর
হেমন্তের অসম্ভব ধোঁয়াটে অসীম অসীম আকাশ
সেই বিষাদ আলোয় পথ খুঁজি আমরা
দেখি, পায়ে চলা লাল পথে পিঁপড়ের শ্রমিক বহর
ফড়িং, চড়ুই আর কাঠবেড়ালির গোপন অগোচরে
নিরবে বাড়ছে কেবল দলা দলা ঘাসের বয়স

বয়স বাড়ছে বিষণ্ন বিকেলের, দেওদারুর
অপুষ্ট বিজ্ঞাপনে সাঁটা বট-পাকুড়ের
অথবা হঠাৎ অবাক রকম বয়স বেড়ে গেলে
কারো হাত গ'লে পড়ে যাচ্ছে অন্তিম চায়ের ঘ্রাণ
এইসব গল্পের খুঁটিনাটি আমরা জেনেছি সঠিক
রহস্য আঁধারে বসে এই রিমঝিম দাবা খেলা
থামছেনা সহসাই, অথবা থামবার নয় যেন ঠিক

তবু হলুদ খামের ভাঁজে ধুলো-জমা কবিতা কয়েক
অভিমানে ঘুমিয়ে থাকে নিরব আঁধারে
স্বপ্নের পান্ডুলিপি কাঁধে কোন এক অচেনা ভোরে
পথে নামি আমরা আবার
আমাদের হাঁটা পথে ধুলো ওড়া উচ্ছ্বাসে
আলগোছে পেরিয়ে যায় ইতিহাসের বিবিধ সময়
পরিত্যাক্ত প্রত্নপ্রাসাদে কোন হয়তো কুড়িয়ে পায়
বাৎসল হাসি-গানের সাদা-কালো পুরনো স্বজন
জানিনা কিভাবে হঠাৎ এইসব ছায়াছবি
বিষম বাড়িয়ে দেয় ধুম্র কফির মেজাজ
আর অহরহ বয়স বাড়ার তীব্র গল্প ভুলে
আমরা অল্প ক'জন কবিতা-বিভ্রমী
লাল লাল প্রত্নভূমিতে মাদুর পেতে বসি...

আকাশও বুঝি বদলে যায়...

খন ছিল ঘুমন্ত দুপুর, আর শতাব্দিও নতুন প্রায়
মিথ্যা চাল-ডাল, টক-শো, রিক্সার বেদম টক্কর
একটা অদ্ভুত ঘিঞ্জি শহর জুড়ে সব আছে প্রচুর,
বহু আগে ফেলে আসা পুরনো সন্ধ্যা-শিশিরের মতো
একদিন কিন্তু সময় ছিল ভীষণ অন্যরকম
মাঠ জুড়ে সবুজ-হলুদ ঘাস আর ধানের অবশেষ
একা একা ঠান্ডা হতো বিকেলে- সন্ধ্যায়
ডানপিটে ছেলে-ছোকড়ারা দৌঁড়ে যেতো হঠাৎ
পুরনো একটা মাঠ জুড়ে হৈ-চৈ আর মুক্ত জীবনের ঘ্রাণ
অনেক লাল স্যুয়েটার আর ঘুড়ি-ঘুড়ি আকাশ কেবল
আবার বকেরা দলছুট আগন্তুক হতো ঠিকই
অর্ধচক্রাকারে উড়ে যেতো ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘের ভাঁজে
ওখানে অনেক নারিকেল-সুপুরির দেশ,
শিশু-মেহগনির কল্পলোকের সবুজ পাতারা
শীতের বাতাসে কেমন ঝরছেতো ঝরছেই
জলপোকার ঝাঁক ছবি আঁকছে শান্ত কালো জলে
আর দুলতে দুলতে নেমে আসা শুকনো ঘোলাটে পাতায়
ঢেকে যাচ্ছে হলুদ রঙচটা ঘর-গেরস্থালির প্রতিবিম্ব

এইসব ছায়াছবি কবে যেন চুপি চুপি কাঁদতে থাকে
খুন-খারাবি, ভোট, বোমা, ক্রিকেট আর
তুমুল ধরপাকড়, হরতাল, সংবাদপত্র, গার্মেন্টস কর্মী
এসব শব্দের তুমুল ঘর্ষণে একদিন
সবুজ ঘাসপাতায় আগুন জ্বলে ওঠে
আমরা যারা বিবিধ ক্ষুধা গিলে গিলে
অনর্গল ফুটপাত ধরে হাঁটতে শিখেছিলাম
মসৃণ গাড়ির ধোঁয়া আর ইঞ্জিনের উত্তাপে
তাদের অশ্রু কবে যেন শুকিয়ে নিঃশেষ হয়
তারপর একদিন মঞ্চ-নাটক, রবীন্দ্র সরোবর, টক-শো
রিকসার চাকা, ফুচকা, সুপারমার্কেট, বিএমডব্লিউ
ফ্রেন্স ফ্রাই, বাণিজ্য মেলা, চারুকলা, বেইলি-রোড
ইত্যাকার মিলেমিশে ভীষণ ভুলিয়ে দেয়
ফেলে আসা কুয়াশার অসম্ভব কোমল সব গান...

ঘুমের বিবিধ বয়ান

আমরা কিন্তু এভাবেই গেঁথেছি জীবনের গান
তোমার কাছে শব্দ অনেক, আমার অল্প কিছু
কিছু শব্দ থাকলো বাতাস আর পুরনো বৃক্ষদের
এত যে শব্দ-খেলা, কেউ তবু নিঃশব্দেরই পরম জাতক
সকাল-দুপুর কষ্ট কিংবা বিষাদের দরজা গ'লে
নিঃশব্দেই আসে ওরা, কেউ আসে বিষণ্ন দীর্ঘশ্বাসে
ওরা যে কারা, ওরা যে কারা, বুঝিনা কিছুই
সারাক্ষণ ভীষণ নরম, কান্না-মুখর হয়ে থাকা
তাতে ঘ্রাণ বাড়ে বাতাসে খানিক, পঙক্তি বাড়ে কবিতায়
স্বপ্নের প্রাণ বাড়ে কিনা, বলতে পারেনা কেউ...

এইসব ভেবে ভেবে অবাক হতে হয় ভীষণ
তাহলে জীবন হলো মৃত্যুর মন্থর প্রতীক্ষা
বিভ্রমে বন্দী আমরা এভাবেই গুনে যায়
অজস্র অন্তিম পাতা, হলুদ, বৃক্ষচ্যুত
বয়সের পাতারাও ঝরে, নিঃশব্দ নিরুদ্দেশে
চিহ্ন তার জমে থাকে বয়সী চোখের কোণে
চিহ্ন জমে স্মৃতিভ্রষ্ট মগজের অলিতে গলিতে
বিভ্রান্ত আগন্তুকের মতো পথ হাঁটি আমরা
ভীষণ কোন লালচে বিকেলে হঠাৎ থমকে যাই
আদিম পুরনো কোন বটের আলিঙ্গনে
কেউ গভীর শুঁকে নেয় মাটির মাতাল রস
ঘাসের মখমল স্বাদে গহীন ঘুমিয়ে পড়ে কেউ
জাগার সময় তাদের কোনদিন হয়না যেন আর
পাখীরা গোপনে দেখে ওদের প্রশস্ত ললাট,
স্বপ্ন-ভেজা চোখ আর বঙ্কিম ঠোঁটে আঁকা রহস্য অপার
তবু অবাক হতেই চায়না যেন ওরা, কেন যে!
ঘুমন্ত জাতকদের স্বপ্নকাতর আকাশ চষে চষে
প্রশস্ত ডানায় একদিন তারপর উড়ে যায় দূরে
খুঁজে ফেরে তুমুল নীলের দেশ, মেঘের কুসুম
কান্না-ভেজানো কোন সবুজ অ্যামাজন কিংবা
জমাট জঙলা ছেঁড়া উন্মাদ ঝাঁঝাঁল বাতাস...

এভাবেই আমরা বাঁচি, অথবা চলে বাঁচার বিধান
নিয়ন জ্বললে ভীষণ নিভে যায় গহীন পুরনো কেউ
জারুল-জামরুল বন আলগোছে কেটে নেয়া গেছে
সেখানে এখন রঙিন প্রাসাদ, ছক কাটা এভিন্যু-স্ট্রিটস
অগভীর লেকের পাড়ে লালচে ইটের সড়ক
সেখানে একাকি হাঁটা যায়, সকালে এবং সন্ধ্যায়
অথবা শুধুই হয়তো বিলাস বিলাস খেলা
এভাবেই চলে মহাকাল, অথবা ঘন্টা কয়েক মাত্র
একদিন অতঃপর রাজপথ, মেঠোপথ, প্রপিতামহ
শ্বেতবস্ত্র, উইল, মিছিল, ফিনাইল, লোবান হয়ে
থিকথিকে অন্ধকারে নির্জন জোনাকির সখ্য হয়ে থাকা...

অথবা নিছক বিভ্রম...

এখানে এখনও অনেক আকাশ
নীল আর নক্ষত্রের নিবিড় দহরম
এখানে এখনও বাতাসের বিবিধ ডানা
বয়েসী বৃক্ষ-বাকল ছুঁয়ে ওড়ে
হয়তো কখনো ধারালো শীতল ফলা
চুষে খায় সাইবেরিয়ার ঘ্রাণ...

এখানে এখনও নিত্য হলুদ সূর্যোদয়
নিমপাতা ছায়া ফেলে শিশুদের গালে
‌ভীষণ নরম করে হাসে শিশুরা
মায়ের তৃষিত কোল ছেড়ে দেবে যেন
গুটি গুটি হামাগুড়ি, অনায়াস শুদ্ধতায়
মিশে যাবে বিবিধ ঝরা পাতা, ফড়িং, ঘাসফুল
আর লালচে কাঁকড়, ধুলো-মাটির দেশে

এখানে এখনও মুঠো মুঠো ছেঁড়া মাঠ
বেঘোরে ঘুমোয় দেখো কিশোরী মটরশুঁটি,
সর্ষের হলদে দেয়ালে বিভ্রম আলোর নাচন
বালিহাস বলাকার কপট গুঞ্জনে
সার বেঁধে পথে নামে কিষাণের দল
রূপালি ফলায় চষে নেয় নরম জমিন
পৌষের কুহক বেলায় মিষ্টি স্বদেশ আমার
নেয়ে ওঠে শিশিরের তুমুল স্নানে
আহা, কী অসীম মমতায়..

হাত পেতে নাও নতুন দিন!

আবারো ঘোলাটে ক্ষুর, ক্ষুধার নখর
উন্মত্ত আঁচড়ে দিলো স্বদেশের উষ্ণ পাঁজর
এখন পৌষের আঁধার কুয়াশায়
অনায়াস যাচ্ছে মিশে ক্ষুধিতের দীর্ঘশ্বাস
পথ চলে গেছে মৃত্যুর শুষ্ক উপত্যকায়
মহেঞ্জোদারোর টেরাকোটা গুহা থেকে বেরিয়ে
হেঁটেছিল যারা একদিন সার বাঁধা পিপড়ের মতো
আজ কংকাল বাহুতে তাদের ক্রোধের বিক্ষোভ
ঠোঁটে খুদ নেই, হাহাকার শূন্য মশক
আহা! এই তবে নতুন বছর!
ক্যালেন্ডার খামচে নামা ধুসর শব্দ-অক্ষর
আতস আলোকে জ্বলা রাতের আকাশ
আর সারি সারি শুকনো থালা, শূন্য গেলাস
এই তবে প্রভাত নতুন!!

কাকে তবে ডাক দেবো আমি
এই ছেঁড়া-ফাটা নিস্তব্ধ ভাটির দেশে?
বিভ্রান্ত ঘোটকীর মতো দিকভ্রান্ত মানুষ
ক্ষুধা আর তৃষ্ণার পীড়নে নাকাল
দিগন্তে ছড়িয়ে আছে শিরশিরে হাত আর হাত
তবু রসাল ফলের মতো লোলুপ দৃষ্টি কতক
মসনদে ঝুলছে এখনও
এখনো রঙিন নিয়নে নামছে সন্ধ্যা
আর ট্রাফিকের দৃষ্টিসীমায় যত সচল ধনবান
তাতে ভীষণ স্তব্ধ হয়ে আসে লুলো ভিখিরীর গান...

চলো কোন নগ্ন পাহাড়ে আমরাও দাঁড়িয়ে যাই এবার
কণ্ঠের সমস্ত উপশিরা ছিঁড়ে ফেলে
ডাক দেই একবার,
দেখি, ভাটির দেশের ঘুম ভাঙবার সময় হলো কি না...

মৃত্যুর মন্থর রিহার্সেল

দূরের এক মফস্বল শহরে অদ্ভুত নিস্তরঙ্গ টাইপ ঈদ কাটিয়ে রাতের আঁধারে রাজধানীতে পালিয়ে এলাম একরকম। শেরাটনের সামনে যখন বাসটা নামিয়ে দিলো, তখন রাত তিনটা।‌ শরীর খানিক খারাপ। বাতাস তেমন চিল্ড না, কাছেই দু-এক জায়গায় ধোঁয়ার ধুলো উড়ছে বাতাসে--নকটার্নাল সিটি-কর্মীর ঝাঁটার কারিশমা, ওষুধের আধ-খোলা দোকানের ফাঁকে জবুথবু একজন বসে আর দারুণ নিরব-নিস্তরঙ্গ চারদিক। আধো-হ্যাঙওভার-টাইপ অবস্থায় খুবলে খুবলে পথ হাঁটছিলাম, রিক্সা একটা দেখে ঝট করে উঠতে হলো। দারুণ নিস্তব্ধ সড়ক, ট্রাফিক সিগন্যাল। রিক্সা ছেড়ে দাও, আবারও খানিক পায়ে হাঁটা পথ, লোহার ফটক, হাতড়ে হাতড়ে দরজার তালা খোলা... অতঃপর এই আধো-নিশ্চিত জীবন হাতের মুঠোর নিয়ে ভীষণ নির্বাসিত বিছানার খুব আপন ঘ্রাণের গাদায় নাক ডুবিয়ে বুদ হয়ে থাকা।

অবশ্য খুব বেশি বুদ হয়ে থাকা হয়না। এই আধা-পোড়ো বাড়িতে এমনকি টিকটিকিরও নড়াচড়া নেই এখন, আলো নেই, ঘরময় পত্রিকা বুনেছে কেউ আর অনিয়ম অলসতার সুযোগে রান্নাঘর থেকে একটা গুমোট গন্ধ পাক খেয়ে খেয়ে সারা বাড়ি ছড়িয়ে গেছে। একটু ফ্রেশ হওয়ার কসরৎ হলো, তারপর কম্বলের ওমে আশ্রয় খুঁজে নেয়া। কিন্তু পরিশ্রমী জলদস্যুর মতো আমার পিছু নিয়েছিল কেউ--ঘুম হলোনা ঠিক। একটা চাপা বিবমিষা, নিউরণে বিভ্রম ঝিমুনি, বারবার বিছানা-বাথরুম করতে করতে রাত গড়িয়ে একসময় ঘড়ির কাঁটা বেলা এগারোটায় এসে দাঁড়ালো। মস্ত পৃথিবীটা হঠাৎ বিরাণ মনে হয় ভীষণ, একটু আতঙ্ক যেন ধীর-ব্যরিকেডে ঘিরছে আমাকে। ক্ষুধা আর তামাটে সময় চৈতন্যকে দুর্বল করে দিতে চাইছে। টান-টান করে হাত বাড়ালেও আমার আওতার মধ্যে মায়ের আদলে কেউ নেই, ভাই-বোন বা মায়াময় স্বজনদের আদলে কেউ সান্ত্বনার নরম আঙ্গুল বাড়িয়ে নেই...

নিস্তেজ পড়ে পড়ে পৃথিবীটাকে হঠাৎই খুব ছোট হতে দেখি। এই ঘুপচি ঘরের বাইরেও কি কিছু থাকতে পারে? এই ঘুপচি ঘর, এই ফোস্কা-পড়া চিকন রাস্তাটুকু, এই মাকড়সা-চিত্রকলার যাদুঘর, এই পুরনো গন্ধ, এই ভীষণ নিস্তব্ধ রাতের মতো সময়, এই অনিশ্চিত অসুস্থ-বিভ্রম, ঘুলঘুলি গ’লে ঢোকা বেগুনি-প্রায় রহস্য-আলো--কিংবা আঁধার হয়তো, বাতাস-জলহীন অদ্ভুত শুষ্ক চারপাশ.. এর বাইরে জগতে আর কিছু থাকতেই পারে না। কেউ যেন হিসেব কষে চেনা জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছে আমাকে। অথচ একদিন আগেও আমি জীবন দেখে এসেছি। কী প্রাণোচ্ছ্বল জীবন, কী প্রচন্ড জীবন, সবুজ ঘাসে কী অপার্থিব কিশোর-ক্রিকেট আর তীর্যক সূর্য-মৈথুন, দূরগামী রেলের পাশে বিভ্রম-কান্তিহীন প্রবীন-পৌঢ় গুঞ্জন, নরম অলসতার কী অপরূপ এক-একটি চিত্রকল্প। অথচ কয়েকটা ঘন্টার ব্যবধানে আমার পৃথিবী চুপসে আসছে কেমন। আতঙ্কের ডালপালাগুলি হঠাৎই যেন শক্ত মনে হয়।

অগত্যা মুঠোফোন আঁকড়ে ধরি। এই যন্ত্রটি নাকি মুহূর্তে সীমানা ছাড়িয়ে মানুষের গোপনতম দরজায় আলতো নক করে আসতে পারে। কিন্তু তাতে কি এই নির্জন শাদা ছাদ, নিঃশব্দ-রহস্য গন্ধময় আদিম গুহার দৃশ্যপট পাল্টে যাবে ? না যাবে না। তবু বোতামগুলিতে এলোমেলো আঙুল চলে খানিকক্ষণ: ‘ফরিদ ভাই, ঈদ মোবারক.. হুম... হুম... হুম... ফরিদ ভাই, আজ অফিসে আসতে পারছি না.. শরীরটা ঠিক ভালনা...।’ কথা ফুরোলে আলো-নেভা মুঠোফোন হাতে দীর্ঘ নিস্তব্ধতা অতঃপর... । আমি জানি, ও ঠিক অফিস থেকে ছুটি নেয়া হয় না, ছুটির ছুতোয় গন্ধ নেয়া হয় মানুষের। যে গন্ধে হয়তো চারপাশের পৃথিবীটার হঠাৎ সঙ্কোচন বন্ধ হবে, বন্ধ হবে ঘুলঘুলি গ’লে বেগুনি অন্ধকারের গলগল অনুপ্রবেশ, অল্প হলেও কেটে যাবে গন্ধ গন্ধ ধোঁয়াশা.. আর অল্পদামী মুঠোফোনটা বালিশের কোচরে গুঁজে হাঁটুতে ভর দিয়ে হয়তো আরেকবার উঠে বসবো বিছানায়.. । এবারের মতো, আরেকবার, বন্ধ হবে মৃত্যুর নিঃসঙ্গ, নিরব, মন্থর রিহার্সেল...

টিএসসি: ডিসেম্বর ২০০৭

এরা সেই গাঁটছাড়া রঙিন মানুষ
দন্ডিত অপুরুষ কেউ, কেউ অনারী প্রতিষ্ঠিত
গ্রহান্তরের তপ্ত ধুলো দিগন্তে উড়িয়ে এসে
এরা গোল হয়ে বসে ঘাসের জাজিমে
চারিদিকে রাজনৈতিক শব্দ-গন্ধের ঝাঁঝ
বাতাসে চর্চিত কার্বণ
টুকরো টুকরো ছড়ানো পর্দায়
নিত্য নিহত হয় অপু আর দুর্গার কিশোর সময়
আর সাদাকালো ক্যানভাসে বেহালার সুর
অনাথের ক্ষুধার তাপে পলকে বাস্প হয়
গাদা করা ন্যাপথলিনের ঘ্রাণ...

রঙিন ঠোঁট, আনন্দ-মথিত কিংবা অভিমানে কাঁপা
সব ডুবে চায়ের দ্রবণে
সদাগরি চামচের টুংটাং জাগছে কোথাও
আর যৌথ হল্লার টগবগে ছন্দে
পঙ্খি-ঘোড়ার পিঠে উড়েই চলেছে সেই বধির সময়
বিকেলটা খসে পড়ে শুকনো আলোয়
আঁধারের বালিকারা হাঁটছে এবার
আর কি দারুণ বিস্ময়!
কোন এক কাঙালের বাঁশির তীক্ষ্ণতা
আশ্চর্য কেঁপে কেঁপে হঠাৎই
নরম ছড়িয়ে পড়ে চিরল পাতার কানায় কানায়...

আমি কিন্তু কাঁদতে বসি
সহস্র যৌথ কণ্ঠের এই ছন্দিত হল্লা
সন্ধ্যার ক্যানভাসে আঁকে গোপন বেদনা
মহাকাল পাতা উল্টায়
পাতা উল্টায় তৃষিতের, ক্ষুধিতের
মগ্ন শব্দ শুনি তার, আর দেখি
জগতের বিষাদময় প্যারাডক্স যেন
কুরোসাওয়ার মত গুটি গুটি ডায়েরি লিখে চলেছে
ডায়েরির পাতা থেকে লবণাক্ত দৃষ্টি তুলে
কখনও যদি আনমনে সামনে তাকাও
দেখবে, বেগুনি ঘ্রাণে বদলে যাচ্ছে জগতের জ্যামিতি যত
মনে রেখো, ওটা পিকাসোর ক্যানভাস...

নির্জন পৃথিবীর গান

ধুলিময় এই ঘর নির্জন পৃথিবীর মতো
এখানে শব্দরাশি ধুসর ভীষণ
পৃথিবীর নাড়ি থেকে ঘ্যাঁচ করে কেটে নেয়া
বিক্ষত নিঃসঙ্গ সত্ত্বা আমার
ক্ষুধা আর যাতনার সামিয়ানা
ছায়া দেয় আমাকে অবিরাম
আমি আঙ্গুল ছড়িয়ে দেই রূপোর পেয়ালায়
তারা উদ্দাম নৃত্য করে
ধুলো-জমা কী-বোর্ডের কোনায় কোনায়
আর চোখ, আর কান, আর কণ্ঠের শক্তি যত
তারা খোঁজে ছন্দের গলিপথ...

এইসব ঘরদোর লোবানের ঘ্রাণের মতো
সাদা সাদা ক্যানভাসে অন্তিম শব্দ আঁকছে শুধু
আমি তবু তিমির হাতড়ে খুঁজি বেহালার সুর
যেন মায়ের গর্ভেই বেঁধে দেয়া দৃষ্টি আমার
দেখিনা কিছুই ঠিক
দূরাগত শব্দশরে তরতর তীক্ষ্ণ হয় শ্রবণের ধার
শুনি ‌মহাকাল কাঁদছে ভীষণ
বিষণ্ন বেদনা তার ঝুলে আছে রাতের আকাশে
ঝুলে আছে নির্জন জোসনার বিষাদ বলয়ে...

তবু এক দুর্বোধ্য কুহক মায়ায়
বিভ্রম আঁকড়ে থাকা ভেজামাটির ঘ্রাণ
আর খুঁজে ফেরা রঙচটা গোধুলির রঙ
নির্জন তৃণভূমির কোনায় কোনায়...

ভেজা চোখের স্বপ্নেরা...

বৃষ্টি ছিল না সেদিন শিরিষের নরম ছায়ায়
ছোপ ছোপ রোদ্র ছিল না তামাটে শূন্য সড়কে
পিচের কাল ঘুম ভেঙে ধোঁয়ার বাষ্প-নদী
অন্ধ করেনি পেখম ছড়ানো নর-নারীদের
শহর ভেঙে সেদিন শুধু অদ্ভুত গতির খেলা...

সাগরের নীলে ভেজা অশান্ত গ্রহাণু থেকে
উপহার আসে ঢের, অজস্র শুভ্র ডানায়
আমাকে উড়িয়ে নেয় অর্ধচেনা মানবী কোন
কৃষ্ণচূড়ার লালচে ঘ্রাণ আলতো সরিয়ে রেখে
আমি বোধ হয় ভাসতে থাকি অবিরাম
বিভ্রমের মতো তন্দ্রাহত চোখে দেখি
সিগ্রেটের ধোঁয়ায় ছায়াছবির মতো হাঁটছে
বেগুনী পোষাকে ঢাকা শিহরিত মানুষের স্রোত,
গল্প, হাসি কিংবা কান্নার চকিত বিস্ফোরণে
ছড়িয়ে পড়ছে অস্থির দিনের সন্তানেরা
আহ কী অদ্ভুত...
পরাবাস্তব স্বপ্নযুগের উষ্ণ গর্ভে বসে
গল্প লিখছে যেন আত্মমগ্ন কেউ...

রাত গভীর হলে গল্পেরা তবু হারাতে চায়
মেঘমালা আসে নরম পদচিহ্ন ধরে
কেউ হয়তো মেলে ধরে ভালবাসা, অনুরাগ
আমি ছড়াই অভিমানী বিক্ষোভ, শুষ্ক অশ্রুজলে
রাত কাঁদে অতঃপর, নক্ষত্রেরা ভেজা ভেজা
বাতাস ঝাপটে ওঠে নারিকেল ডানায়
আর কতক দীর্ঘ আঙুল, অভিজ্ঞতায় লাল
আঁচড়ে ফেলে অলস চৈতন্য, বোধের পরমাণু
ভেজা মাটির তীব্র ঘ্রাণে বেড়ে ওঠা এই আমি
বিলাসী বিষণ্নতায় বারবার তবু স্বপ্নই দেখে যাই...

অতঃপর অন্ধকারেই হাঁটা যাক...

অক্টোবরের দেয়াল থেকে গড়িয়ে নামছে রাত
আর ইতিহাসের পাতা থেকে গল্পের কালচে দ্রবণ
সেখানে রাজার দেউড়িতে গানের আসর
তানপুরা কিংবা ট্রাম্পেট, বাঁশি নাকি হুইসেল
আর সারি বাঁধা সবুজ মানুষের পোষাক ছিটকে ওঠা
রাইফেলের একচ্ছত্র শব্দের কোরাস
হাসি নাকি কান্নায়, কে জানে, বাতাসে চাবুক হেনে
সূর্য কিংবা নতমুখী রংধনু ঢেকে দেয় এক লক্ষ কবুতর
কালো কালো শিশুদের মেলায় দাঁড়িয়ে একদিন
সাদা ডানার গানকে আমরা স্বাধীনতা বলতাম
আজ চলছে এক রঙিন নাটকের ঠান্ডা রিহার্সেল
আর নীল কিংবা বেগুনি পোষাকে জবুথবু হাঁটছে
একটি সমগ্র বাংলাদেশ...

শীতের আকাশ আর কুয়াশার অন্ধকার পানপাত্র
সাজিয়ে রেখেছি উঠোন জুড়ে, বহুদিন হলো,
অথচ আঁধারের কাকেরা খোঁজে মতার ক্ষুদ
আর এখন শহরে আমাদের সুউচ্চ প্রাসাদ
বাতাসে ওডিকোলন কিংবা কয়েক ফোঁটা বিলেতি মদ
তামাটে কুয়াশার মতো এখানে ওখানে
নিরবে দাঁড়িয়ে আছে ক্রুদ্ধ কারাগার
একদা যাদের কথার উষ্ণতায় জ্বলে গিয়েছিল
ভাটির অঞ্চলের শীতার্ত মানুষেরা
তাদের স্বপ্নেরা আজ হেমন্তের হিম হিম রাতে
জ্বলজ্বলে জমে আছে অন্ধকার কচুপাতায়...

নিঃসঙ্গ রাত্রির সাথে কথোপকথন

ক্লান্ত ছায়া কারো গড়িয়ে নামে কাঁচের দেয়ালে
আর রাত গভীর হয় অমাবশ্যার মতো
সেঁধিয়ে যায় ব্ল্যাকহোলের থকথকে অন্ধকারে
শহরের মিনারে চড়ে দৃষ্টি আমার
চুরি করে ঘুরে দেখে রাতের আকাশ
ওখানে ক্ষুধা নেই, জলের গেলাস নেই
নেই প্যারাট্রুপারের মতো স্বপ্নের সুতীব্র পতন
কেবল নিঃসীম মেঘের তৃণভূমি
অশ্মথের ছায়ার মতো ছেঁড়া ছেঁড়া, রহস্যময়
সাদা আলোর রথে অগণিত আত্মা যেন তীর্থের পথে...

নির্বোধ পৃথিবী কেন দিগন্ত খাঁমচে আনে রাত আর দিন
গোধুলি কেন জাফরান আগুন ঢালে নদীর থালায়
কঙ্কাল বৃক্ষের চামড়া গ'লে গ'লে
যে জোছনা ভিজিয়ে রাখে ঘাস আর বিষাক্ত বুনোফুল
সেখানে কেন হিসহিস ফুটতে থাকে ময়ালের পদচ্ছাপ
কেন এইসব দুর্বোধ্য সংকেত, সৃষ্টির কোটরে কোটরে
কেন এইসব শ্যাওলার মতো প্রগাঢ় রহস্যসম্ভার...

যাদের জীবন জোনাকির মতো
নিকষ কোন সন্ধ্যায় তীব্র জ্বলে জ্বলে
যারা কালো পাথরের মতো অজানায় ঘুমিয়ে যায়
তারা চায় এইসব শহরের নির্ভুল দেশান্তর
যদি ভেসে যেতো এইসব নিয়ন, প্রাসাদ আর কোলাহল
যদি উল্কাপাতে জ্বলে যেতো আদিম কৌতুহল
শিশুদের গালে আগুনের লাল কারুকাজ
আর অন্ধকারের শিরশিরে লতাপাতা
হাত বাড়ালেই ধরা যায় মেঘের মাখন শরীর
অশ্রুর মতো ভেজা, আর হিমহিম হেমন্তের মতো
মেঘের ওপরে হলদে ঘুড়ির আকাশ, ধনুকের উত্তল ছায়াপথ
ঈগলের আঁচড়ে বন্য গন্ধ মাখা ঘুর্ণি বাতাস
বাতাসের এই উন্মত্ত ডানায় ভেসে চলো
একসাথে ডুব দেয় সিন্ধুর প্রখর স্রোতে
হাতের তালু মিশিয়ে পান করি
জীবনের বঙ্কিম ঝাঁঝাঁল স্বাদ...

এসো নভোচারী! মাটির কারাগারে...

দারুণ বিস্ময়, শব্দমালার ঝরঝর ঝরে পড়া
সুরের পারমানবিক দোলা চুলের মুঠি ধরে
আমাকে ছুঁড়ে দেয় মেঘের পাথুরে জায়নামাজে
সুরের ঈগল পরবাসী, যান্ত্রিক প্রাসাদে নির্বাসিত
প্রেয়সীর হাত হয়ে ঝুপ করে গ’লে পড়ে সে
বহুলকর্ষিত কর্ণকুহরে; শিলাবৃষ্টির মতো অঝোর
জমাট বরফ তার উষ্ণ প্রস্রবণে গলতে থাকে
নুনের অশ্রু সাগরে, ভালবাসার বিষণ্ন উত্তাপে...

ভূগোলের সমস্ত আকাশ সৃজনীদের জন্মভূমি
সুরের শুভ্র জাহাজ আটকে দিয়োনা কখনো
দাগ-কাটা সীমান্ত পিলারের উটকো কারাগারে
সমস্ত মাটির অণু-কণায় রক্তের খোরাক আমার
ওহির মতো প্রশান্ত ঝর্ণাধারায় স্নান করে
হিংস্র ক্ষুধার্ত হয়ে আছে সমগ্র আদিম হৃদয়
আকাশ উপুড় করে দাও সালওয়া-প্যারাট্রুপার
ধসিয়ে দাও প্রাক-সভ্য জনপদের ক্ষুধার পাহাড়...

ডানা দুটো নক্ষত্রের তিমির অন্ধকারে ছড়িয়ে
মাটির সামনে এসে দাঁড়াও তুমি, যাযাবর
এইতো বাড়িয়ে দেয়া ইতিহাসের কুহক হস্তলিপি
আমার হলুদ তালু শুকে দেখো মুদিত চোখে
তীব্র জমে আছে শুধু মানুষেরই ঝাঁঝাঁল ঘ্রাণ
আর রক্তের তাজা ধোঁয়া, গোলাপের শরাব জামে
তবু প্রভাত লালিমার ঘুম ভাঙিয়ে চলে যাও তুমি
অতিপ্রাকৃত নভোচারী হয়েই পরম তৃপ্ত হও...

নিঃসঙ্গ যাদুর ভাস্কর

প্রথম দেখেছিলাম তাকে
দুপুরের পাটাতন থেকে পিচঢালা রাস্তায় গড়িয়ে যেতে
তারও আগে নিয়ন নগরে
যেখানে ঘ্রাণ আর কুজনের সেলাই চলে
কৃত্রিম আলোতে চলে
একঘেয়ে নাটকের নিখুঁত অভিনয়‌
সেখানে মগ্ন চৈতন্যে শুনেছি প্রথম পদশব্দ
যার কাঁচভাঙা চিৎকারে গ্রহণ লেগেছিলো
সেদিনের প্রধান নক্ষত্রের...

তারও পরে হাঁটি হাঁটি করে
সাঁঝের গন্ধ-মাতাল অগণিত কন্ঠস্বর
দুলে ওঠে কোরাস আবাহনে
প্রলম্বিত শুষ্ক প্রহর শরাবে ডুবতে থাকে মন্থর
বিদায়ের অন্ধ ভেজা প্রহরে
বর্গাকার শিল্পকর্মের মতো দাঁড়িয়ে থাকে সে
সহজাত শব্দমালা ক্যালিগ্রাফী হয়ে
তীব্র সুঘ্রাণের ঘায়ে দুমড়ে মুচড়ে
বাতাসে মিলিয়ে যায় অকস্মাৎ

আবার সে ফিরে আসে বর্ষা বিকেলে
প্রাণোচ্ছ্বল উড়ে যায় টেরিকাটা শহরের প্রান্ত এঁকে
ইতিহাসের রেসিপি থেকে কৃত্রিম মেন্যু ছুঁয়ে
নির্বিকার দাঁড়িয়ে থাকে সর্বহারা বাতাসের মুখোমুখি...

এক নির্দোষ অপরাহ্ণের ডায়েরি

অতঃপর সত্যিই একদিন
লাল জলাধারে জমা হলো
পাহাড় ফুঁড়ে নেমে আসা আটটি প্রস্রবণ
আর বাস্পের ডানায় ভেসে সবাই
উড়ে গেলো সবুজ তৃণভূমির ল্যাণ্ডস্কেপে

তবে ঘুরে আসা যাক কল্পজগত
ওখানে কংক্রিটের দলায় টেরাকাটা প্রত্নতত্ত্ব
সমাজ সভ্যতার কয়েক শতাব্দী
নিবিড় হয়ে জমে আছে
কৃত্রিম দেয়াল ঘেরা জনাকীর্ণ গুঞ্জনে
বাতাসে ইতিহাসের ঘ্রাণ
পোড়ামাটির আস্তর খসে উদ্দাম
পূর্বপুরুষের বৈভব পাণ্ডুলিপি
আর রোদের তীর্যক চাহনিতে
জ্বলজ্বলে জ্বলছে
আদিযুগের রহস্যময় হায়ারোগ্লিফিক্স

সময়ের তীক্ষ্ণ ঝটকায়
লহমায় পৌঁছি আমরা উত্তর আধুনিকে
ইতিহাসের ঘ্রাণমত্ত চোখে সামনে তাকাই
দেখি আকাশে চলেছে ভেসে দস্যু জাহাজ
চিৎকার হৈ চৈ-এ কোরাসবদ্ধ জেগে ওঠে
ঈষৎ প্রলম্বিত কৃত্রিম শহর
আর জলের গহীন থেকে বাতাসের পরমাণুতে
অবিরাম প্রতিধ্বনি তুলে ছড়িয়ে পড়তে থাকে
দানা দানা উচ্ছ্বল সময়...

সময়ের দখিনা বাতাসে
আমাদের খেয়া তরী আলগোছে পেরিয়ে যায়
উত্তর আধুনিক ঘ্রাণের পাহাড়...

এক নরম গোধুলিকে সারি রেখে
পশ্চিমাকাশ বিছিয়ে নিয়ে বসেছি ক’জন
দিগন্তে প্রচ্ছন্ন ভীষণ
সহস্র মিনারে সাজানো বাতাসের শিকাগো শহর
বিরতীহীন নিঃশ্বাসের ঢেউয়ে উড়ে গেলে সমস্ত প্রলাপ
কথা বলে মৌণ দিগন্ত বিশাল
অস্তিত্বের ক্ষুদ্রতায় হঠাৎ
দারুণ চুপসে পড়ি আমরা ক'জন...

অন্তহীন রাজপথ

কিছু রাজপথ অন্তহীন
কল্পজগতের শিরিষ বাগান হয়ে
জেগে ওঠে দৃশ্যপটে
দৌড়ে হেঁটে অনায়াস অতীতে দ্রবীভূত হয়
তিমির পুরনো বায়োস্কোপের মতো
দুর্গম ভূগোল ছিঁড়ে টুপ করে ঝরে পড়ে
অবাধ্য ব-দ্বীপ, দক্ষিণ প্রচ্ছদ
নিঃসঙ্গ খঞ্জ একাকি মিলিয়ে যায় অসীম বসন্তে

কিছু রাজপথ ইতিহাসের মতো বোবা
অনেক বিক্ষিপ্ত জলাধার নির্বিকার বন্দী করেছে তাকে
সময়ের ব্যারিকেডে
এখন সবুজ আর সতেজ স্বপ্ন বাঁধা আকাশের আস্তিনে
ক্যালেণ্ডারের সবুজ তারিখে লেখা মানুষের ভাগ্যলিপি
তবু স্বর্গের সনদ পেলো বোবা রাজপথ
অশ্রুর কাব্য পেলো অগণিত
প্রহর আর প্রজাপতির প্রবল মিথুনকালে
বর্ষা ছাপিয়ে পেলো নিষ্কলুষ উল্লাস

পথিকের রাজপথ একমুখী
হিসেবের খাতা ছিঁড়ে আকাশের ছায়াপথে
নিঃশেষ হারিয়ে যাওয়ার মতো
তবু বৃষ্টিমালার অঝোর কালিতে
নিখুঁত খোদিত হয়ে র'ল
এইসব অন্তহীন রাজপথের গল্পসম্ভার...

অন্ধ কুশিলবগণ

মৃত্যুর কড়াই থেকে খুবলে আনা জীবন
তীরের ফলায় গেঁথে শূন্যে ছুঁড়ে দিলাম
এই আমার নিরঙ্কুশ বাজি
নিশ্চিত কোনদিন পড়বে ধসে এই উত্তপ্ত প্রাসাদ
ধসে পড়বে রঙিন কুশিলবগণ
আর ভীষণ দমকা বাতাসে
ভস্মকণার মতো ছড়িয়ে পড়বে দানা দানা মিউজিক

এখানে এখন মিটমিটে আলোর বরফ, কাঁচ ভাঙা চোখ
আর ভীষণ কম্পনে উড়ে আসছে অন্ধ ঈগল
ভূমধ্যসাগরের তীব্র নীল ইতিহাসের গহীন থেকে
তুমি দেখে নিও এই পাটাতন ভেঙে যাবে
ভেঙে যাবে কাঁচের অতীত, স্বপ্নমাদুলি
আর নিমজ্জমান চিৎকারে
চিরতরে উড়ে যাবে হলুদ অতিথি অনেক

তবু বন্ধ হবে না কখনো
সুরের ডানায় চড়ে বিষণ্ন পঙক্তির সুতীব্র পতন
শিহরিত চোখে ক্রোধের চিহ্ন খুঁজি নীল আসমানে
কোথায় কিভাবে হায়ারোগ্লিফিক্স-এ জমে আছে
তিমির অন্ধদের ভাগ্যলিপি
একক ইঙ্গিত স্বল্পই বটে
এবার যৌথ ইঙ্গিতের তেলআবিব হয়ে
কালো পাতায় খোদিত হবে এই বয়োজ্যেষ্ঠ অন্ধ প্রাসাদ...

ঘ্রাণ মিশেছে এই আশ্রমের দেয়ালে

বেনিয়া কামান গোলা, লোভের অনল
প্রত্যাঘাতে আছড়ে পড়ে যেসব নারিকেলবাড়িয়ায়
সেসব কেল্লার মতো মসৃণ আশ্রয় তুমি
আকাশ ধরেছো বুকে, সাগরে ভিজেছে মন
ইতিহাস শিশুর আদলে ঘুরেছে তোমাকে ঘিরে
আর মায়ার তুমুল তরঙ্গ সাঁতড়ে
তুমি চায়ের গেলাস পৌঁছে দিয়েছো
তিন লক্ষ তৃষিতের কঠিন শুষ্ক দ্বারে
কিভাবে পারো যে তুমি
এভাবে পেরিয়ে যেতে পতিত হেমন্ত...

আমি তোমাকে দেখি ছাতিম গাছের মতো
মমতায় অবনত
পরিত্যাক্ত জুটিদের কান্না আর কোলাহল
আলুথালু পিষ্ট হয় তোমারই ছায়ায়
আর পরিশ্রান্ত শ্রমিকের ঘর্মাক্ত চেতনা
প্রশ্রয় পায় তোমার নিষ্কলুষ অবগাহনে
কী নরম বিস্ময় তুমি
এইতো বাতাসে উড়িয়ে দিলাম হৃদয় কপাট
ঘুর্ণির ক্ষিপ্রতায় ফুঁসে ওঠা
তোমার দুরন্ত বাতাস চেতনা নাড়িয়ে যাক...

শহুরে গেলাস - ২

নক্ষত্র তোমাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে থাকে
স্পর্শের সীমানায় শিউলি মহুয়া
কৃত্রিম আলো-আঁধার যাদের
বিষণ্ণ মিকেল্যাঞ্জেলোর মতো দাঁড় করিয়ে দিয়েছে
ল্যামপোস্টের তলে,
তারাও হয়তো মানুষ
কারো জানালায় নীলচে জৌলুস
নরম স্যান্ডেলের মতো
ইতিহাসের বারান্দায় হাঁটে কেউ
কারো স্বপ্নের দ্রবণ গড়িয়ে নামে
শরাবের পেয়ালায়
তবু শহরের অস্থির ভার ধরে রাখে
ল্যামপোস্ট আর বিষাদ মিকেল্যাঞ্জেলো

গোল্ডফ্লেকের ঘ্রাণ ক্যানভাস বিষিয়ে তুললে
অনুমতি মিলে অন্তহীন ঘুমের
চোখের চোরাগলিতে নরম মধ্যাহ্নের স্বাদ
সেই ভেজা চলচ্চিত্র দেখতে দেখতে মিলিয়ে যাবে
অশরীরি প্রহরের সমস্ত হলুদ কুহক

মিথষ্ক্রিয়া

এক গ্লাস বেনোজল আর
কয়েক কোটি নিথর উদ্বাস্তু
ডানে-বাঁয়ে রক্তের মতো লাল দুপুর
কখনও ভীষণ তপ্ত বৃষ্টি
পাথুরে শিলাঝড় কখনও আবার
পথিক চলেছে তবু
বাদামী স্যুটকেসের মতো
বুকে চাপা দলা দলা পূর্বপুরুষ
আর মগজে দায়ভার অভিশাপ

পৃথিবীর গতিপথ শেষ হয়না
যতই পেরিয়ে যাও মৃতপ্রায় সরিষা ক্ষেত
ডানপিটে ফড়িং এর মতো
কিংবা শালিক অনেক
অজানা ঔদার্যে যাদের আকাশ ভরা খুনসুটি
এসো ক্ষুধার্ত চাতক
আরেকবার ডুব দেই লালদীঘিতে
হাতড়ে হারিয়ে দেখি
ক'দানা মুক্তো জমলো জলের অতলে
ঝিনুক-খোলস বারুদে উড়িয়ে দিয়ে
শুষে নেয়া যাক পঙ্কিল সম্পদ

এখনো রক্তদুপুর চারপাশে
ক্ষুধার্ত, গৃহপালিত উদ্বাস্তুর পাল
পৃথিবীর পাথুরে পথ কখনও শেষ হবার নয়...

আহা! দুর্গন্ধ গ্যাংগ্রিন!! (একটি অনুনাদী উচ্চারণ)

তখন সামহয়ারে নতুন বসন্ত। পুরনো পাতা ঝরে গেছে। ডাল-পালা পত্র-পত্রালি সবই নতুন। চেহারায় জেল্লা ভাব প্রবল। ঝাঁকে ঝাঁকে মৌসুমি পাখিরাও আসছে। কৃষ্ণচূড়ার এ শাখা ও শাখায় মিষ্টি মিষ্টি মানুষের খুনসুটি। মন্দ না! আমি যাযাবর মানুষ। কোথাও থিতু হওয়ার ধাত নেই। এখানে ঘুরেছি, ওখানে থেমেছি, এর ওর কুঁড়েতে দু-এক পেয়ালা চা। ব্লগটাকে মনে হয়েছে আমাদেরই ঢাকা শহর যেন। একটু রোদ, একটু বৃষ্টি, এখানে একটু নরম ছায়া, ওখানে বিষাক্ত কালো ধোঁয়া, বিচ্ছিরি শব্দের অন্তহীন সড়ক কিন্তু সব ছাপিয়ে ছাপিয়ে অনেক অনেক মায়া।

ছিটকে পড়ি বটে। কিন্তু বৃত্তাকার পথ বারবার আমাকে ছুড়ে দেয় সামহয়ারে। এবার পা রাখতেই দুর্গন্ধ বাতাস ঘিরে ধরলো। নাহ, এ নিশ্চয়ই ভুল। দুই দিন, তিন দিন, চার দিন। ভুলটাই তবে সত্যি?! প্রিয় শহরটার সারা শরীরে গ্যাংগ্রিন হয়ে গেছে। গন্ধে তার আকাশ ভারি।

রক্তের গন্ধও কম কি? গোত্র-দ্বন্দ্ব চলছে ভীষণ। এর ওর মাংস চিবিয়ে কি আমিষের সাধ মিটবে? ভয়ে ভয়েও আছি। হুট-হাট হারিয়ে যাওয়া উদ্বাস্তুদের 'নীতিকথা' গৃহস্থেরা কিভাবে নেবে। বহুল চর্বিত ভাষায় হয়তো কেউ ঝলসে উঠবেন: "চুপ বেটা, কিছু জানোস না..."। চুপ থাকতেই তো চাইছি ভাইটি। সরব হয়েছি শুধু একটু নিরব আকাশ পাবো বলে।

ভাষার কথা তো নিত্যই ভেসে যাচ্ছে। আমি বরং অন্য কথা বলি। এই যে ভার্চুয়াল মহাসাগর। ব্লগ নামক বস্তু এখানে তো কম নেই। সবগুলোর খোঁজ খবর জানা স্বাভাবিক নয়। যেটুকু জানি ন্যাড়া মাথা নিয়েও এরকম বেদম চুলাচুলির খবর কখনও চোখে তো পড়েনি। কে যেন দুঃখ করেছেন ব্লগটা চ্যাটরুম হয়ে উঠছে। আমার দুঃখ হয় নি। মনে হয়েছে এটা সামহয়ারের বারতি গুণ। এটা ব্লগ, এটা ফোরাম, এটা চ্যাটরুমও - মন্দ কি? কিন্তু যেভাবে কাদা উড়ছে আকাশে বাতাসে, তাতে সামহয়ার কিছু নবিশের ছেলেখেলার ক্যানভাস হয়ে উঠছে প্রায়ই - দুঃখ সেখানেই।

আগাছার ভয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্থ থাকে নবিশ চারাগাছ। মহীরুহকেও আগাছা ভীতি তবে গ্রাস করলো? একসময় অনেক বড় বড় ব্লগার ছিলেন এখানে। তাদের লেখনিতে ছিল স্বপ্ন। ছিল হাত বাড়িয়ে আকাশ ছোঁয়ার সাধ। এখন আকাশ নেই, ঈগল নেই, কোন আগাছা বড় দুলছে বাতাসে, সেটাই কিভাবে, কবে যেন আরাধ্য হয়ে গেছে বটবৃক্ষের, দেওদারুর। স্বপ্ন ছড়ানো গদ্য-পদ্য হারিয়ে তো যাবেই।

শুধু সুপুরির বহর দিয়ে বাগান হয় না । সেটা হয় ব্যাবসার পসরা। কিছু সুন্দরী, কিছু গরান-কেওড়া, কিছু বিষাক্ত কাঁটাগুল্ম, কিছু সরীসৃপ, জঙ্গল-কাঁপানো কিছু রয়েল বেঙ্গল-- তবেই না গড়ে উঠবে হাত বাড়িয়ে ছোঁয়ার মতো এক টুকরো নরম সবুজ সুন্দরবন।

শহুরে গেলাস

নদীতটে প্রান্তিক বিভৎস প্রাসাদের
অগ্রজ সিলিকা দন্ডে ঝুলছে
পরবর্তী সজীব সভ্যতা,
গাছের ক্ষুরে আটকে গেছে
গতির সর্বশেষ সমিকরণ,
আর কতক নিষিদ্ধ জলযান উড়ে আসছে
বৈকালিন সবুজ মহাসড়কগুলোতে।
এভাবেই তরতর গড়িয়ে ফিরবে
তিতকুটে চিরতার মতো আরেকটি নিশ্চিত সকাল।

বিষের পেয়ালা ভরে পান করেছি তাই
জীবানুরোধক পীতাভ সরাব
আর খানিকটা হেঁটে নেবো নির্ভিক
হলুদ ঘাসে চেতনাহীন হারিয়ে যাবার আগে
তবু নখের খাতায় এঁকে সমস্ত নিষিদ্ধ গলিপথ
তপ্ত সড়কের পথিক হবো আমরা আবার
রক্ত জ্বালানি নিংড়ে নেয়া ভীষণ এই বিপন্ন সময়ে।

লিরিকস নিয়ে ফিরলুম

আকাশ ভেঙে মেঘ করেছে
চেতন ভাঙা হাসি,
বৃষ্টি ভেজা নরম বিকেল
ভীষণ ভালবাসি।

বৃষ্টি নতুন, বৃষ্টি অঝোর
চোখ ভিজেছে ভারি,
উদোম পায়ে ভিজবো এবার
রোদ্র তোমায় আড়ি।
মন ম’জেছে কদম ঘ্রাণে
বনবাতাসি ডাকে,
দুপুর গ’ড়ে বিকেল হারায়
স্বপ্ন জেগেই থাকে।
ঝপাৎ নামে সাঁঝের আকাশ
ঝিঁঝিঁর কোরাস বাঁশি,
বৃষ্টি মুখর মগ্ন আঁধার
ভীষণ ভালবাসি।

দিন মিলিয়ে সাঁঝ গড়ালো
নিয়ন আলো ফিকে,
কুহক চাদর আসলো নেমে
দিগন্তে দশদিকে।
বৃষ্টি মাতাল মগ্ন পথিক
জিরোবে কোথায় বলো,
মেঘের ভাঁজে তারার পৃথিবী
দৃষ্টিটা ছলছল।
ঘুম ঘুম দেশে স্বপ্ন পরীরা
কেঁদে যায় পরবাসী,
মোমের আলোয় চলনা একাকি
কবিতা নিয়েই বসি।

[অনেকদিন ব্লগে আসতে পারিনি। আজ আসলাম। সদ্য লেখা লিরিকসটা পোস্ট দিলাম।]

মৃত্যুপুরাণ

আমাদের অস্তিত্ব উদ্দাম হয় বাতাসের অন্ধকার দমকে
আর ভীষণ চাউর হলেও সমস্ত শহুরে স্বাদ-গন্ধ
নাগালের ওপাশ দিয়ে উড়ে যায় বহুতল টাওয়ারের দিকে
তবু কী যে হলো মধ্য সকালে আজ
শরাবের পিপেয় জমানো শিশিরের নোনতা জল
ঝরঝর ঝরে চলেছে সবুজ বৃষ্টির সাথে

মহাকালের নোটবুকে টুকে রেখেছি এইসব হলুদ দিনলিপি
জানি, আজ কলঘর কাঁদবে সারাদিন
রক্তশূন্য এক ফ্যাকাশে মানবের স্মরণে
যার নরম বেদনাহত চোখ লবণ মিশিয়ে গেছে
অনাগত গভীর সরোবরে, ঘোলাটে প্রস্রবণে

আজই আমি চিঠি পেলাম অন্ধকার মেঘমালার
বার্তা পেলাম নিষিদ্ধ বিষবৃক্ষের, ঝরা পাতার
আর মধ্যরাতের ঠান্ডা ঝুলি ছিটকে বেড়িয়ে পড়া নৈঃশব্দের জটাজাল
আমাকে শাসিয়ে গেলো ভীষণ রকম
হয়তো বেদনা অনেক, হয়তো মুখ গোঁজা উটপাখীর মতো
অসহায় হিংস্র গহীন ভেতরের কেউ
হ্যাঁচকা টানে ছিঁড়ে খুঁড়ে গেছে রক্তাক্ত আত্মপরিচয়

নিত্যদিন এক নিঃস্ব-কাতর মৃত্যুযন্ত্রণা দেখতে দেখতে
কবে যেন রাজসাক্ষী হয়ে গেছি আমি
আর আপন মনে দাঁড়িয়ে আছি এক কল্পিত পাহাড়ের পাদদেশে
একদিন ঠিক নিঃশেষ গড়িয়ে নামবে এক প্রাণহীন স্বপ্নশব
আর আমি ওর শিয়রে দাঁড়িয়ে অশ্রুদগ্ধ অট্টহাসিতে ফেটে পড়বো...

নষ্ট সময়ে বোদলেয়ার

আমার হাত ধরে সবুজ ক্যালেন্ডার আর
তুমি ব্যাটা ঘড়ির রেডিয়াম ডায়াল
ঘামতে ঘামতে বেশ দারুণ পাল্টে গেলে
দেখছো তো, এরা সব শহরের মানুষ
ফেরীঅলার মতো সকাল-সন্ধ্যা ঘামের স্রোতে স্নান
আর সূর্যের যে চকচকে ঝরণা এখন বোশেখের ছাতে
তাতে জগতের গ্রামার যায় বদলে, আর
বোদলেয়ার চলে আসে প্রায়ই উপকথার শাখা-প্রশাখায়
ফরাসী রেস্তোরাঁর স্বাদ তখন নাকের ডগায়...

ওরা কিন্তু মজদুর মানুষ, কালো পেশল বাহু
অবহেলায় ঢেকে রাখে আউলা-ঝাউলা শার্টের হাতায়
তবে বাস্তিল-ফাস্তিল আর কি কি যেন সব
অবসর পেলেই ওরা মনে করিয়ে দেয় রক্তের কথা
যাদের সন্তান সন্ততি হাঁটে, দৌড়ায়
মাংশল পেশীর আড়ালে আবডালে
ওদের প্রতিজ্ঞা ভীষণ
সময় সুযোগ পেলেই পেতলের হাতুড়ি দিয়ে গুড়িয়ে দেবে
সবুজ ক্যালেন্ডার আর মিটমিটে রেডিয়াম

তো সাবধানে চলাফেরা করতে হয় আজকাল
দিনকাল যে তেমন সুবিধার না
সেতো আকাশে তাকালেই বোঝা যায়
প্রায়ই হলুদ রক্ত ঝরে মেঘের মশক থেকে
আর এতযে বাদ্য-বাজনা, সিম্ফনি, রিদম
সুরের পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে কোরাস দৌড়ঝাঁপ
গীটারের পঞ্চম কর্ড তবু স্যাঁতসেঁতে রয়ে যায় ভীষণ রকম

দায়টা শেষমেষ তোমাদের ঘাড়েই
হে সবুজ ক্যালেন্ডার আর বিদঘুটে ডিজিটাল টিকটিক
এমনিতেই সহস্র বিভাজন চারিদিকে
তবু এক খ্যাপাটে বেকুবের মতো উন্মত্ত অধ্যবসায়,
ধারাল অস্ত্রোপচারে টুকরো করে চলেছো
দিন-মাস-ঘন্টা-মিনিট, প্রতিনিয়ত, অবিরাম...

কতিপয় ডায়েরীর কাতিব

রাত্তির কখনো নির্জন পাহাড়ী ঝর্ণার মতো
চেতনার পাষাণ পাথরে স্যাঁতসেঁতে শেওলার জনক
আর কষ্টেরা চকচকে লাল প্রায়শই
বিকেল-আলোর অল্প আঁচে অযুত জঙলায়
জেগে থাকা উদ্ধত বেদানার লজ্জারাঙা গহীন বরণ

আমাদের এই শহর এখন জ্বলছে-নিভছে নিশিদিন
তবু পুরনো ঐকিক নিয়মে খুঁড়িয়ে পথ চলা খামাখাই
আর খুঁটে খাওয়া নতুন বারুদের খুদ, জীবাণু অশেষ
কিংবা গণতান্ত্রিক এক গ্লাস হলুদ জুসেই
কয়েক বছর নিশ্ছিদ্র ঘুম আর মহৎ রক্তপাত অজস্র

তুমি তো দেখবেনা এক ফোঁটাও
কখনো লাগাম ফসকে শিলাবৃষ্টির মতো অহী নাযিল হলে
আমাদের পদবী হয় ডায়েরীর কাতিব
আর আমরা খোদাই করতে বসি দুর্গন্ধ বাতাস
অথচ মেঘেরও অধিক নিকষ কালো ছায়া এঁকে
প্রাগৈতিহাসিতক ঘ্রাণের মাদকতায় উড়ে বেড়ায়
ময়লা দাঁতের রাজা-উজির আর ওমরাহ শত শত

আমরা বিপন্ন বোধ করবো- ভাবি সবসময়
শনিবার সকালে কিংবা বৃহস্পতির নরম সন্ধ্যায়
এমনকি বসন্তের খুব একাকি কোন
ঘোর লাগা নির্দোষ নক্ষত্ররাতেও..

অস্তিত্বের তুমুল আকাশ

কখনো অস্তিত্ব আমার উথলে পড়ে
প্রহর আর প্রস্থানের পিছু পিছু
কখনো আমিত্বের ত্বক আর মাংসপিন্ড
যাতনার বিষবাষ্পে ভস্ম হয়
অসার কঙ্কাল হয়ে হাঁটি আমি
এক মৃতপ্রায় চৈত্রের নরম হাত ধরে
বধ্য-দুপুর কিংবা প্রবাহমান নক্ষত্ররাতে

আলো-ছায়ার সিগন্যালে ক্যালেন্ডার নাচে, সময় নয়
পৃথিবীর সমস্ত দগ্ধ আকাশ বুকপকেটে ফেলে
চকচকে বর্শার ইশারায় ছুটে চলে সে
অশরীরি রানারের মতো

সভ্যতার সতের হাজার চোরাগলিতে দাঁড়িয়ে
অস্তিত্বকে জানতে চেয়েছি আমি
বুঝতে চেয়েছি সময়ের রঙ আর উষ্ণতা
কোথায় আকাশ আর শূন্যতার নিবিড় আলিঙ্গনে
অসার হয়ে থমকে দাঁড়াবে সময়?
অবহেলায় খসে পড়া আপন অস্তিত্বগুলোকে
ঝরে পড়া বোশেখী আমের মতো
কাড়াকাড়ি কুড়িয়ে পাবো কোথায় আবার?

সভ্যতার চোরাগলি কথা বলেনি
আর বধ্যভূমিগুলোর আড়াল থেকে উঠে আসা
সাদাকালো চেহারাগুলো
আমার অর্বাচিন প্রশ্নমালাকে চাবুকে রক্তাক্ত করে
আত্মমগ্ন হারিয়ে গেছে অকস্মাৎ
ইতিহাসের ধুলো জমা পাতায় পাতায়...

মধ্যবর্তী রাতের চাতাল

রাতের চাতাল ভাঙছে চতুর্দিকে
আর অস্থিরতারা ভাসছে বাতাসে
ফেটে যাওয়া শিমুল-দানার মতো
উড়বার সাধ তাদের
উড়বার সাধ ইট-সুড়কির,
দুর্নীতির নির্যাসে পুষ্ট ব্যাঙাচিদের
আর দুর্লঙ্ঘ ফটকের ছায়ায়
জেগে থাকা প্রহরীদের
যাদের বুটের চকচকে বাঁকে
প্রতিদিন চেহারা দেখে ভোরের সূর্য

রাতের চাতাল ফাটছে চারদিকে
নিষিদ্ধ বেলুনের মতো,
পাথরের আঘাতে ছিন্নভিন্ন মস্তক
আর ছড়িয়ে পড়া বর্ণবাদী তরলের মতো
রাতের চাতাল ফাটছে আর
ষড়যন্ত্রেরা কাঁপছে সতর্ক পুষ্টিতে
বড় বড় সড়কে, দালানে
বড় বড় মগজের ঘুলঘুলিহীন কোটরে

কাল নিশ্চিত সূর্য উঠবে জেনেও
কারো কারো ঘুমের জাজিমে জমছে ঘাম
আর চোখের লেন্সগুলোতে সিলিংয়ের গান
অবিরাম ঘুর্ণিপাকে প্রতিনিয়ত গড়ে চলেছে
কুরোসাওয়ার সাদাকালো স্বপ্নমালা...

আগুনের বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা

এইতো হামাগুড়ি দেয়া ভোরের সড়ক
দুপুরের ছায়াঢাকা মর্গ আর
ক্রুদ্ধ সন্ধ্যার ছিঁড়ে নেয়া ছিটমহল
তীক্ষ্ণ ছোবলে নির্দয় প্রহর
ক্রমাগত চষছে আমার বুক
আর মধ্যাহ্ন চৈত্রের বহ্নিশিখা
এফোড় ওফোড় করে
শুষে নেয় নদী-নালা
চুমুকে নিঃশেষ করে
অলিন্দে বয়ে চলা উষ্ণ প্রস্রবণ

কুড়ানো রণ'পার প্রতিটি ল্যান্ডমার্কে
পৌঁছি আমি ভেজা ভেজা ধ্বংসস্তুপে
ইতিহাসের কর্কস স্রোত
বয়ে যায় লাফিয়ে লাফিয়ে
আর পুরনো অশ্বক্ষুরের ধুম্র মেঘে
পারমানবিক শীতল কোরাস

সতেরো হাজার জিজ্ঞাসার সশস্ত্র প্রহরায়
আমার উড়াল এখন অজানায়
প্রতিটি স্টেশন এখন ব্যাবিলন
আর লাল চাবুক হাতে
অনাগত যুবাদের সামরিক অভ্যর্থনা

লাল কাগজে সত্যি দরখাস্থ করেছি আমি
নক্ষত্রের আগুন থেকে এবেলা
দু'ফোটা বৃষ্টি হোক...