Thursday, October 23, 2008

নন্দীগ্রামের গল্প

নন্দীগ্রামের রহস্যময় মাঠে আগুন জ্বলছে আজ। রাতের গুমোট অন্ধকারে আগুন ঘিরে বসা মানুষগুলোকে আদিম গুহাবাসীর মতো ক্ষ্যপাটে দেখায়। বাতাসে আগুনের ফুলকি ওড়া দেখে ছেলে-বুড়ো-নারী। আর দেখে বৃদ্ধ গুরুলি আকবরকে। আগুনের একটু দূরে খানিক উঁচু আসনে নন্দীগ্রামের প্রাচীন এক শিমুল গাছের নিচে সৌম্য ভঙ্গিতে বসে বৃদ্ধ গুরুলি আকবর। তার শান্ত প্রাচীন জ্বলজ্বলে চোখ আর সাদা দাড়িতে গলগলে রহস্য খেলে। আগুনের হলদে-লাল দাবানলের গভীরে তাকিয়ে বৃদ্ধ গুরুলি আকবর গল্প শুরু করেন...

...সেবার আশ্বিনে হঠাৎ খুব একটা ঝড় হয়ে গেলো। মেয়েটার ওড়না যে আমগাছে পাওয়া গিয়েছিল সেই গাছে কোনদিন আর মুকুল ধরেনি। খড়ের চালার নিচে চাপা পড়েছিল সে। আর তার কাপড়-চোপড় ছড়িয়ে ছিল নদীর কূলে এখানে ওখানে। সে বছরই কোত্থেকে কে জানে অদ্ভুত লোকটা এসে উঠলো বাবু অবিনাশের বাড়ি। এত লম্বা কাউকে নন্দীগ্রামের কেউ আর কোনদিন দেখেনি। দিনে শুধু একবারই নদীতে গোসলে যাওয়ার সময় তার চেহারা দেখা যেতো। অদ্ভুত লম্বাটে ভাবলেশহীন চেহারা কিন্তু কী ভীষণ জ্বলজ্বলে চোখ। তার পরিচয় কেউ জানেনা আর কেউ তার সাথে কথাও বলেনি। সে আসার এক সপ্তাহের মধ্যে কলেরায় মারা গেল বাবু অবিনাশের ছেলেটা। পরের সপ্তাহে মারা গেলেন বাবু অবিনাশ। পরের সপ্তাহে তার স্ত্রী। বাবু অবিনাশের স্ত্রীর দেহ চাটাইয়ে মুড়ে একা একা শ্মশানে নিয়ে গিয়েছিল অদ্ভুত লম্বা লোকটা। আর কোনদিন তাকে দেখেনি কেউ। বাবু অবিনাশের বাড়িতে এরপর বছরখানিক পা পড়েনা কারো...। তারপর একদিন সেটা পাড়ার যুবকদের ক্লাবঘর হয়ে যায়...

বৃদ্ধ গুরুলি আকবরের এরকম সৌম্য গল্পের পর বাতাস বন্ধ হয়ে যায়। আগুনের ফুলকি ওড়া কমতে থাকে আর ভীষণ রকম স্তব্ধতায় নন্দীগ্রামের ছেলে-বুড়ো-নারী সবাই থমকে থাকে। নাড়ার গাদা পুড়িয়ে আগুনের কুন্ডলি একসময় কান্ত হলে ধীরে ধীরে খালি হয় নন্দীগ্রামের অদ্ভুত মাঠ। আগুন কুন্ডলির ভাপ-ওঠা তাপের পাশে একা বসে থাকেন শুধু বৃদ্ধ গুরুলি আকবর। তার হাতে কাগজের তৈরি ছোট্ট একটা নৌকো। নন্দীগ্রামের ছোট্ট শশি স্কুলের খাতার কাগজ ছিঁড়ে নৌকোটা বানিয়ে দিয়ে গেছে তাকে। দূর আকাশে এক অজানা তারা খসতে দেখে উঠে দাঁড়ান বৃদ্ধ গুরুলি আকবর। লালচে কাল ছাইয়ের আগুনে ছুঁড়ে দেন কাগজের নৌকোটি। মরতে বসা আগুন শেষবারের মতো তীব্র জ্বলে ওঠে শুধু।

পরদিন খুব সকাল সকাল শিশু গাছে ঘেরা নন্দীগ্রামের সবুজ পুকুরটার চারিদিকে ঘন হয়ে ওঠে মানুষের ভীড়। পুকুরের ঠিক মাঝখানে পানির ওপর শান্ত ঘুমিয়ে আছে নন্দীগ্রামের ছোট্ট শশি। ভোরের পুকুরের মতোই গভীর শান্ত নৈঃশব্দের মধ্যে হঠাৎ কারো তীব্র আর্তনাদ বেজে উঠলে আমাদের নন্দীগ্রামের গল্প এবারের মতো এখানেই শেষ হয়।

No comments: