Thursday, October 23, 2008

মৃত্যুর মন্থর রিহার্সেল

দূরের এক মফস্বল শহরে অদ্ভুত নিস্তরঙ্গ টাইপ ঈদ কাটিয়ে রাতের আঁধারে রাজধানীতে পালিয়ে এলাম একরকম। শেরাটনের সামনে যখন বাসটা নামিয়ে দিলো, তখন রাত তিনটা।‌ শরীর খানিক খারাপ। বাতাস তেমন চিল্ড না, কাছেই দু-এক জায়গায় ধোঁয়ার ধুলো উড়ছে বাতাসে--নকটার্নাল সিটি-কর্মীর ঝাঁটার কারিশমা, ওষুধের আধ-খোলা দোকানের ফাঁকে জবুথবু একজন বসে আর দারুণ নিরব-নিস্তরঙ্গ চারদিক। আধো-হ্যাঙওভার-টাইপ অবস্থায় খুবলে খুবলে পথ হাঁটছিলাম, রিক্সা একটা দেখে ঝট করে উঠতে হলো। দারুণ নিস্তব্ধ সড়ক, ট্রাফিক সিগন্যাল। রিক্সা ছেড়ে দাও, আবারও খানিক পায়ে হাঁটা পথ, লোহার ফটক, হাতড়ে হাতড়ে দরজার তালা খোলা... অতঃপর এই আধো-নিশ্চিত জীবন হাতের মুঠোর নিয়ে ভীষণ নির্বাসিত বিছানার খুব আপন ঘ্রাণের গাদায় নাক ডুবিয়ে বুদ হয়ে থাকা।

অবশ্য খুব বেশি বুদ হয়ে থাকা হয়না। এই আধা-পোড়ো বাড়িতে এমনকি টিকটিকিরও নড়াচড়া নেই এখন, আলো নেই, ঘরময় পত্রিকা বুনেছে কেউ আর অনিয়ম অলসতার সুযোগে রান্নাঘর থেকে একটা গুমোট গন্ধ পাক খেয়ে খেয়ে সারা বাড়ি ছড়িয়ে গেছে। একটু ফ্রেশ হওয়ার কসরৎ হলো, তারপর কম্বলের ওমে আশ্রয় খুঁজে নেয়া। কিন্তু পরিশ্রমী জলদস্যুর মতো আমার পিছু নিয়েছিল কেউ--ঘুম হলোনা ঠিক। একটা চাপা বিবমিষা, নিউরণে বিভ্রম ঝিমুনি, বারবার বিছানা-বাথরুম করতে করতে রাত গড়িয়ে একসময় ঘড়ির কাঁটা বেলা এগারোটায় এসে দাঁড়ালো। মস্ত পৃথিবীটা হঠাৎ বিরাণ মনে হয় ভীষণ, একটু আতঙ্ক যেন ধীর-ব্যরিকেডে ঘিরছে আমাকে। ক্ষুধা আর তামাটে সময় চৈতন্যকে দুর্বল করে দিতে চাইছে। টান-টান করে হাত বাড়ালেও আমার আওতার মধ্যে মায়ের আদলে কেউ নেই, ভাই-বোন বা মায়াময় স্বজনদের আদলে কেউ সান্ত্বনার নরম আঙ্গুল বাড়িয়ে নেই...

নিস্তেজ পড়ে পড়ে পৃথিবীটাকে হঠাৎই খুব ছোট হতে দেখি। এই ঘুপচি ঘরের বাইরেও কি কিছু থাকতে পারে? এই ঘুপচি ঘর, এই ফোস্কা-পড়া চিকন রাস্তাটুকু, এই মাকড়সা-চিত্রকলার যাদুঘর, এই পুরনো গন্ধ, এই ভীষণ নিস্তব্ধ রাতের মতো সময়, এই অনিশ্চিত অসুস্থ-বিভ্রম, ঘুলঘুলি গ’লে ঢোকা বেগুনি-প্রায় রহস্য-আলো--কিংবা আঁধার হয়তো, বাতাস-জলহীন অদ্ভুত শুষ্ক চারপাশ.. এর বাইরে জগতে আর কিছু থাকতেই পারে না। কেউ যেন হিসেব কষে চেনা জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে চাইছে আমাকে। অথচ একদিন আগেও আমি জীবন দেখে এসেছি। কী প্রাণোচ্ছ্বল জীবন, কী প্রচন্ড জীবন, সবুজ ঘাসে কী অপার্থিব কিশোর-ক্রিকেট আর তীর্যক সূর্য-মৈথুন, দূরগামী রেলের পাশে বিভ্রম-কান্তিহীন প্রবীন-পৌঢ় গুঞ্জন, নরম অলসতার কী অপরূপ এক-একটি চিত্রকল্প। অথচ কয়েকটা ঘন্টার ব্যবধানে আমার পৃথিবী চুপসে আসছে কেমন। আতঙ্কের ডালপালাগুলি হঠাৎই যেন শক্ত মনে হয়।

অগত্যা মুঠোফোন আঁকড়ে ধরি। এই যন্ত্রটি নাকি মুহূর্তে সীমানা ছাড়িয়ে মানুষের গোপনতম দরজায় আলতো নক করে আসতে পারে। কিন্তু তাতে কি এই নির্জন শাদা ছাদ, নিঃশব্দ-রহস্য গন্ধময় আদিম গুহার দৃশ্যপট পাল্টে যাবে ? না যাবে না। তবু বোতামগুলিতে এলোমেলো আঙুল চলে খানিকক্ষণ: ‘ফরিদ ভাই, ঈদ মোবারক.. হুম... হুম... হুম... ফরিদ ভাই, আজ অফিসে আসতে পারছি না.. শরীরটা ঠিক ভালনা...।’ কথা ফুরোলে আলো-নেভা মুঠোফোন হাতে দীর্ঘ নিস্তব্ধতা অতঃপর... । আমি জানি, ও ঠিক অফিস থেকে ছুটি নেয়া হয় না, ছুটির ছুতোয় গন্ধ নেয়া হয় মানুষের। যে গন্ধে হয়তো চারপাশের পৃথিবীটার হঠাৎ সঙ্কোচন বন্ধ হবে, বন্ধ হবে ঘুলঘুলি গ’লে বেগুনি অন্ধকারের গলগল অনুপ্রবেশ, অল্প হলেও কেটে যাবে গন্ধ গন্ধ ধোঁয়াশা.. আর অল্পদামী মুঠোফোনটা বালিশের কোচরে গুঁজে হাঁটুতে ভর দিয়ে হয়তো আরেকবার উঠে বসবো বিছানায়.. । এবারের মতো, আরেকবার, বন্ধ হবে মৃত্যুর নিঃসঙ্গ, নিরব, মন্থর রিহার্সেল...

No comments: