তামাক কিংবা লিচুর ঘ্রাণে বড় হ’তে হ’তে ভয়ঙ্কর কৃষ্ণচূড়ার এক আলো করা সকালে এক হাঁটু ঘাসের জগতে শখের যাদুর কাঠি হারিয়ে ফেলে এক ছোট্ট শ্যামল মেয়ে। তারপর লাল ফড়িং আর এত্তো এত্তো বুনোফুলের ঘ্রাণ ভুলে সে বেলা কেবল যাদুর কাঠির সন্ধান চলে। সকাল গড়িয়ে-হামাগুড়ি দিয়ে-দৌড়ে দুপুর হয়, বিকেল হয়, হেমন্ত-শীত-বসন্ত হয়, তবু যাদুর কাঠির দেখা মেলে না ঠিক। শ্যামল মেয়েটা অগত্যা অল্প-অল্প বড় হ’তে হ’তে একদিন মাতৃভূমি ছেড়ে একাকি বেরিয়ে পড়ে।
অল্প বমি-ভাব নিয়ে মেয়েটা যেদিন ময়লা ট্রেনে চাপে, সেদিন তার হাত কাঁপে, পা কাঁপে। দুর্বল হাতে ব্যাগ টেনে পানের পিক-অলা জানালার পাশে বসলেও অনেক পুরনো শহর আর পরিচিত জনদের চেহারা অশ্রুতে ঝাপসা হয়। তারপর কুলিদের কোরাস দেখে ট্রেনের হুইসেল কেঁদে উঠলে মেয়ের হঠাৎ ভীষণ সব অন্যরকম কথা মনে পড়তে থাকে। সে দেখে তার যাদুর কাঠি টুকরো হয়ে জগৎ জুড়ে ছড়িয়ে গেছে। সেসব টুকরো কুড়িয়ে গুছিয়ে না নিতে পারলে সুয়োরানী-দুয়োরানীর নরম পুরনো খেলার সুখ সে আর কোনদিন খুঁজে পাবে না। এরকম বিষম চিন্তায় মায়ের নিজের হাতে গুঁজে দেয়া নাড়ু-মুড়কির ঘ্রাণটাও একসময় কেমন ফিকে হয় যেন।
শিক্ষক, বাবা-মা কিংবা শুভ্রকেশী গুরুজনদের চোখ এড়িয়ে যেসব নরম বিকেলে মাঠ, পুকুর পাড়, পাবলিক লাইব্রেরি চত্ত্বর, বিকেল-নদীর পাড় আর ফুচকার দোকানে টিন-এজ বন্ধুদের সাথে আড্ডা জমানো গেছে, সেসব উন্মাদ তারুণ্যের কালে কিভাবে যেন ফিরে ফিরে আসতো শ্যামল মেয়েটির রঙিন যাদুর কাঠি। সেই টুকরোটি কেবল জমে আছে থলেয়। এসব ভাবনায় সওয়ার হয়ে রাজধানীতে প্রবেশ করলে রাজধানীর উষ্ণ হাওয়ায় গ্রামজ চোখের পানি অগত্যা শুকাতে থাকে। তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশমুখে রঙিন সোডিয়ামের মতো আলোয় জীবনের প্রমত্ত বছর ক’টি উজ্জ্বল সেলুলয়েড হয়ে যায় হঠাৎ।
তখন কেবল স্বপ্ন কুড়িয়ে নেয়ার সময়। রমনা, সোহরাওয়ার্দী, নীলক্ষেতে মোড়া এই কাদামাটি দ্বীপেই কেন যেন স্বপ্নের প্যারাস্যুট ঝরে রাতদিন। এখানে সংস্কৃতির যৌথ ব্যঞ্জনা, বইমেলার ঘ্রাণ, মঞ্চ নাটক, ফার্স্ট ইয়ার, ফটোকপি-লাইব্রেরি, হঠাৎ বিস্ফোরিত শ্লোগান, চারুকলা, শর্ট-ফিল্ম, পেঁয়াজু, আলুর চপ, সস, চা, দেরিদা, ফুকো, সার্ত্র, গার্সিয়া মার্কেজ আর পাবলো নেরুদার শ্রমজীবি কবিতা বুকে নিয়ে নরম ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে থাকার দিনগুলোতে আরেক টুকরো সোনার কাঠির দেখা মিলে যায়। কিন্তু তারপরেই জীবন কেমন যেন চুপসে যেতে থাকে হঠাৎ। জীবিকার জোয়ালের টানে উত্তপ্ত রাজপথ ছেড়ে বরফকলে ঢুকে পড়লে বিশাল আকাশ আর তুমুল বৃষ্টির গল্পগুলো আস্তে আস্তে শুকাতে থাকে যেন। তবু ঝকঝকে সোনার কাঠির খোঁজে একদিন যে ঘর ছেড়েছিল, সেই শ্যামল মেয়ের গোপন বেদনায় বরফকলের অন্ধকারে এক চাপা কান্নার কোরাস উথলে ওঠে আজও, এখনও।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment