বলেশ্বরির গোরস্থান মাঠে একটা লম্বাটে কফিন ঘিরে দাঁড়িয়ে আছি আমরা সাতজন। জঙ্গলা টাইপ গোরস্থানটাতে খুব দ্রুত সন্ধা নামছে। পুলিশ অফিসার বিদ্বান কফিনে টর্চ মারলেন। কফিনের এক কোনা থেকে তাজা রক্ত গড়াচ্ছে তখনও। অদ্ভুত একটা দুর্গন্ধও পাওয়া যাচ্ছে। বিশু ডোম নিশ্চিত করেছে এটা কোনভাবেই মানুষের লাশের গন্ধ নয়। পুলিশ অফিসার, গোরস্থান মসজিদের ইমাম, আমরা তিন সাংবাদিক সবাই থ’, বিশু ডোমের একটু কপাল কুচকায়। শুধু নির্বিকার পান চিবোতে দেখা গেলো মসজিদের মুয়াজ্জিন বজলু মুন্সীকে। কফিনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে সে বললো, ‘আমার কাছে খবরাখবর আছে’। গালের কোনা দিয়ে গলগল করে পানের রস পড়ে গামছা ভিজে গেলেও তাকে বিব্রত দেখালো না। সে চলে গেলো মসজিদের ভেতরে।
খবরাখবর বলতে গোরস্থানের রেজিস্ট্রেশন খাতা। এখানে যেসব কফিন আসে তাদের নাম পরিচয় লেখা থাকে এই খাতায়। কফিনের প্রানীটির পরিচয় খুঁজতে খুঁজতে একনাগারে নিচু গলায় কথা বলে গেলো বজলু মুন্সী। “কোফিন এইখানে রাইখা গ্যাছে সকাল সাতটার দিকে। লোক আসছিল মনে লয় সাতজন। এক লম্বা মোতোন লোক আমারে লাশের নাম-ঠিকানা কইলো। লোকটার শইলে মনে হয় কুষ্ঠু। মুখের চামড়ায় ফ্যাকাশে ধরছে। মাটির দিকে তাকায়া কতা কয়। নাম-ধাম কওনের পর কইলো তাড়াতাড়ি চইলা আইবো...।”
লাশের নাম-ধাম পাওয়া গেছে। অদ্ভুত!! কী ব্যপার বজলু মুন্সী? সিরিয়ালে না লিখে দুই পাতা বাদ দিয়ে লিখেছেন কেন? বজলু মুন্সী ফাঁকা দুই পাতা বারবার উলটায় কিন্তু কিছুই বুঝতে পারে না। বিড়বিড় করে ‘আমি তো সিরিয়ালেই লেখিচি...।’ তার কথা কেউ খেয়াল করে না। হুমড়ি দিয়ে নাম-পরিচয় দেখতে থাকে...
নাম: বাদাদা
পিতা: ইনিজা
পেশা: অবসরপ্রাপ্ত শিক, ধুনট কলেজ
ঠিকানা: ৪৩, কুতুবখালি রোড, ধুনট
পুলিশ অফিসারের ওয়াকি-টকি কথা কয়। না স্যার, কুতুবখালি রোডে ৪৩ নম্বর কোন বাড়ি নেই। ৩৭ নম্বরের পরেই নদীর এমব্যাঙ্কমেন্ট। ওখানে ধাম-ধাম করে নদীর ঢেউ আছড়াচ্ছে। আর ধুনটে তো স্যার কোন কলেজই নেই। একটা প্রাইমারি স্কুল আছে শুধু।... পুলিশ অফিসার বিদ্বান হঠাৎ কিছু বুঝতে পারেন না। বোবা সময়ের পর পুলিশের ওয়াকি-টকি আবার সক্রিয় হয়-‘স্যার, এক গাড়ি সোলজার।’ বিশু ডোম মুখে কাপড় বেঁধে হাতে গ্লাভস পড়তে থাকলে পুলিশ ঘুরেন আমাদের দিকে। ‘আপনারা যান ভাই, পরে খবর পাবেন।’ ঘন হয়ে আসা রাতের ভেতর দিয়ে পুলিশের গাড়ির সাইরেন কানে বাজলে হঠাৎই জোরে জোরে শ্বাস নেয়া শুরু করে বিশু ডোম। অদ্ভুত বিকট গন্ধটা আমাদের নাকেও বাড়ি মারে। বালেশ্বরীর গোরস্থান মাঠ ছাড়ার আগে একবার শুধু ঘুরে তাকাই কফিনের দিকে। থই থই ঘন কালচে রক্তে ভেসে যাচ্ছে জনৈক বাদাদার কফিন।
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment